ইনসাফভ্রষ্টতার পরিণতি অবধারিত by আবু জাফর

অনেক দিনের পৃথিবী। হজরত আদম আ: থেকে অদ্যাবধি এই পৃথিবীতে মানুষের বসবাস। বলা আবশ্যক, এই দীর্ঘ কালব্যাপী পথ পরিক্রমায় সময়ের দাবি এবং মানুষের স্বাভাবিক সংস্কার প্রবণতার কারণে মানুষের বিশ্বাস ও অভ্যাসে বিভিন্ন দিকে অনেক রূপান্তর বা পরিবর্তন হয়েছে।
মানুষ যেহেতু সর্বদা সম্মুখের দিকে অগ্রসরমান, পরিবর্তন মানুষের স্বভাবধর্ম। তাই খুব সঙ্গত ও স্বাভাবিকই মানুষের চিন্তা ও উপলব্ধিতে পরিবর্তন এসেছে, দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি ও সৌন্দর্যচেতনায় পরিবর্তন এসেছে, এমনকি ভালোমন্দের ধারণা ও দিকনির্দেশনায়ও এসেছে পরিবর্তন। কিন্তু একটি বিষয়ে মানববিশ্বাস একই রকম অনড়, অবিচল ও শাশ্বত। সময় ও সভ্যতার উত্থান-পতন সে বিষয়টির গায়ে কোনো রকম প্রভাব ফেলতে পারেনি, নতুন কিছু ভেবে দেখার কোনো অবকাশ সৃষ্টিই হয়নি। বিষয়টি হলো ইনসাফ। এই ইনসাফ মানবসৃষ্টির ঊষালগ্নে যেমন ছিল, এখনো তা একই রূপে ও একই অবয়বে বিদ্যমান। মানুষ ইনসাফের বিপরীতে দণ্ডায়মান হয়েছে, ইনসাফ বৈরী আচরণ করেছে কিন্তু ইনসাফের বিকল্প কিছু দাঁড় করাতে সক্ষম হয়নি, সেই ধারণাও কারো মনে কখনো জাগেনি। অর্থাৎ ইনসাফ নির্বিকল্প ও শাশ্বত। জড়জগৎ, প্রাণিজগৎ, আকাশ ও পৃথিবী, জল স্থলে অন্তরীক্ষে ইনসাফ সর্বত্র সমানভাবে বিরাজমান। ইনসাফ আল্লাহ পাক প্রদত্ত একটি অবিচল ব্যবস্থা বা সুন্নাহ, যার ব্যত্যয় ব্যতিক্রম ঘটা বা ঘটানো সম্ভব নয়। ইনসাফের এই বিকল্পহীন অবস্থানকে আল কুরআন বলছে, মিজান অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট সুনির্ধারিত ভারসাম্য (সূরা আর রহমানÑ আ: ৭-৯)।

এখন প্রশ্ন হলোÑ এই ‘মিজান’ বা সুনির্ধারিত ভারসাম্য বা ইনসাফ, যা বিশ্বজগতের  ুদ্রবৃহৎ সব ক্ষেত্রে ও সর্বত্র ব্যত্যয়হীনভাবে প্রতিষ্ঠিত ও সক্রিয়, মানুষের দ্বারা তা কিভাবে লঙ্ঘিত হতে পারে? মানুষ কিভাবে এই বিধানকে তার আপন ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির ক্রীড়নকে পরিণত করতে পারে? পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, অক্সিজেন মানুষের জন্য অপরিহার্যরূপে প্রয়োজন, কিন্তু কেউ ইচ্ছা করলে এই অক্সিজেন নাÑ নিজে প্রয়োজনের এতটুকু অতিরিক্ত গ্রহণ করতে পারে, না মানুষকে বিপদাপন্ন করার দুরভিলাষ নিয়ে অক্সিজেনকে নিজ নিয়ন্ত্রণে কুক্ষিগত করে রাখতে পারে। এভাবে আল্লাহ পাক প্রদত্ত সব নিয়ামতই একটা চূড়ান্ত ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে কোনো মানুষের পক্ষেই কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করা বিন্দুমাত্র সম্ভব নয়। সম্ভব নয়, তবু মানুষ বেইনসাফ ও নাফরমান হিসেবে চিহ্নিত হয় কী করে! হয় এ জন্য যে, মানুষ যেখানে অপর মানুষের সাথে সম্পর্কিত, যেখানে মানুষ কিছুটা স্বাধীন, সেখানে মানুষ তার কর্মে ও ভাবনায় এমন আচরণ করে এবং করতে পারে, যখন ইনসাফ ও ন্যায়বোধ বিঘিœত হয়। এই অবস্থাকেই বলা হয় বেইনসাফি, বলা হয় ন্যায্যতার খেয়ানত, বলা হয় ন্যায়বিচারে ভ্রষ্টতা।

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, এসবের মধ্যে নিবিড়ভাবে অবিচ্ছেদ্য থেকেই মানুষের জীবন। এই ঘনবদ্ধ মানবজীবনের কোথায়ও যদি ভারসাম্যের অভাব ঘটে, সর্বমানবিক প্রীতির বদলে যদি ব্যক্তিস্বার্থ প্রবল হয়ে ওঠে, তবে তা ইনসাফের খেলাফ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘অপরের মধ্যে নিজেকে অনুভব করার নামই ভালোবাসা’। অর্থাৎ নিজের অস্তিত্ব ও চেতনাকে আপন-পর বহু মানুষের মধ্যে সম্প্রসারিত করার নামই সর্বমানবিক প্রেম। এটি যত বিস্তৃত হবে মানুষ্যত্ব নিষ্ঠা তত বেশি ব্যাঙময় হয়ে উঠবে, আর যত বেশি সঙ্কুচিত হবে তত বেশি স্বার্থান্ধ হয়ে উঠবে মানুষ। তখন সত্য ও ন্যায্যতার আলোকবর্তিকা নিভিয়ে দিয়ে মানুষ হয়ে উঠবে অন্ধকার জগতের অন্ধ বাসিন্দা। এই অবস্থায় ইনসাফের কোনো অস্তিত্ব থাকে না, স্বাভাবিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে পড়ে। রাসূল সা: বলেছেনÑ ‘তোমরা নিজের জন্য যা পছন্দ করো, অপরের জন্যও তা-ই পছন্দ করবে।’ এটাই ইনসাফ যা সর্বমানবিক অকৃত্রিম প্রীতি ও সহমর্মিতাকে প্রাঞ্জল করে তোলে। আমরা সততই মানবাধিকারের কথা। বলি কিন্তু সমূহ দুঃখের কথা, আমাদের অন্তর ও আচরণ এটুকু মানবিক দাবি ও অঙ্গীকার করতে পারে না। অর্থাৎ আমরা আমাদের কঠিন ও কুৎসিত আত্মসর্বস্বতা থেকে বেরিয়ে জীবনকে ইনসাফবদ্ধ ভালোবাসার ভূমিতে দাঁড় করাতে প্রায় অক্ষম। তাই জীবনে অনেক কিছুর সমাহার ঘটলেও ভারসাম্যহীন অনুচিত প্রবণতার কারণে জীবন অত্যন্ত জটিল রূপ পরিগ্রহ করেছে।

মানুষের জীবনে এবং সম্প্রসারিত বিবেচনায় সমগ্র মানবসভ্যতায়, ইনসাফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বস্তুটির অভাব ঘটলে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যেমন অসুন্দর হয়ে ওঠে, পুরো মানবসভ্যতায়ও কুশ্রীতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইনসাফের কী আকাশচুম্বী মহিমা, মানব সভ্যতায় ইনসাফ কী অমøান আলোকবর্তিকাস্বরূপ, কিছু উদাহরণ সহযোগে আমরা তা প্রত্যক্ষ করতে পারি। হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম ভাষণেই বললেন, তাঁর কাছে সবল ও শক্তিশালী মানুষ হলো সেই ব্যক্তিÑ যার ন্যায্য পাওনা এখনো অনাদায়ী রয়ে গেছে এবং সবচেয়ে দুর্বল হলো সেই ব্যক্তি যার কাছ থেকে দুর্বলের ন্যায্য প্রাপ্য এখনো আদায় করা হয়নি। এই বিষয়টি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করাই তাঁর প্রথম কাজ। এই খলিফার জন্য ভাতা নির্ধারণের প্রশ্ন যখন উঠল, তখন তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন, যে মানুষটি সর্বাপেক্ষা নিম্নপরিমাণ খরচে সংসার নির্বাহ করে, তাঁর (খলিফার) ভাতা যেন কোনোক্রমেই এই দরিদ্র মানুষটির সংসার খরচকে অতিক্রম না করে। এটাই হলো ইনসাফ, এই হলো ইনসাফসমৃদ্ধ মানবতার উদাহরণ। খলিফা উমর রা: দায়িত্বভার গ্রহণের পর আমৃত্যু ১০ বছর শুধু জায়তুনের তেলে শুকনো রুটি খেয়ে জীবন নির্বাহ করেছেন। তিনি গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে বলতেন, ফোরাতের নদীতীরে একটি কুকুরও যদি অভুক্ত অবস্থায় মারা যায়, আল্লাহ পাকের কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। কী অনবদ্য আল্লাহভীতি ও ন্যায়বোধ! হজরত আবু হানিফা রা: ছিলেন একজন বস্ত্র ব্যবসায়ী। তাঁর কর্মচারীরা বিভিন্ন দেশে কাপড় বিক্রয় করত। একবার তিনি দেখলেন, কাপড়ে কোথাও কিছু খুঁত আছে। তিনি কর্মচারীদের উত্তমরূপে বুঝিয়ে দিলেন, কাপড় যেখানেই বিক্রি হোক, ক্রেতাকে যেন এই খুঁতের কথা সঠিকভাবে জানিয়ে দেয়া হয়। কর্মচারীরা ফিরে এলে তিনি জানতে চাইলেন, খুঁত সম্পর্কে ক্রেতাদের ঠিকভাবে জানানো হয়েছিল কি না। কর্মচারীরা বলল, তারা বিষয়টি বলতে ভুলে গেছে। ইমাম আবু হানিফা রা: বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ নিঃশেষে সাদকা করে দিলেন। এটা শুধু সততা নয়, আল্লাহর ভয় দ্বারা চালিত একজন মানুষের সতত জাগ্রত ন্যায়বোধ এবং তিনিই সেই ইমামে আজম যিনি খলিফা কর্তৃক পুনঃপুনঃ নির্দেশিত হওয়া সত্ত্বেও কঠিন নির্যাতন ভোগ করেছেন; কিন্তু প্রধান বিচারপতির পদ কিছুতেই গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি ধারণা করেছেন, খলিফার প্রভাবমুক্ত হয়ে তিনি ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখতে পারবেন না।

ইনসাফনিষ্ঠা শুধু সাধারণ সৎ গুণাবলির অন্যতম একটি নয়, ইনসাফ হলোÑ বিশ্বজগতের একটি অপরিহার্য নীতি ও অলঙ্ঘনীয় মানদণ্ড, মানবসভ্যতার মধ্যে সতত প্রবাহমান সক্রিয় প্রাণশক্তি। অর্থাৎ সততা, সত্যনিষ্ঠা, অকৃত্রিম মানবপ্রেম, সত্য প্রতিষ্ঠায় হিম্মত, ত্যাগ ও কোরবানি, বিশ্বস্ততা, নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ জীবনাচার, পরার্থপরতা, ধৈর্য, সহিষ্ণতা ইত্যাদি গুণ মানুষের জীবনকে ধন্য ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে সত্য; কিন্তু ইনসাফের ভূমিকা অনেকখানি ভিন্ন। ইনসাফ ব্যক্তিজীবন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রকে একটা কঠিন দৃঢ়তার ওপর প্রতিষ্ঠিত করে রাখে, যার এতটুকু অন্যথা হলে পুরো বিশ্বসংসার অনিবার্য হুমকির সম্মুখীন হয়, সর্বত্র অস্থিরতা ও বিপর্যয় নেমে আসে এবং এই জন্যই ইসলাম যে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে, ইনসাফ সেগুলোর অন্যতম।

এটা সত্য যে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছেও ইনসাফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটাও সত্য, নীতি ও নৈতিকতাভ্রষ্ট আধুনিক পৃথিবীতেও ইনসাফের দাবি শীর্ষে অবস্থান করছে। তবু এটুকু ব্যক্ত করা সবিশেষ প্রয়োজন যে, মাত্রাগতভাবে ইনসাফের যে সুউচ্চ অবস্থান ও অবিসংবাদিত মূল্য ইসলামে অবশ্যমান্য, ততটা অন্য কোথাও পরিদৃষ্ট হয় না। কোনো মুসলমানের পক্ষেই এই বিষয়টি লঘুভাবে দেখার ন্যূনতম অবকাশও নেই। লোভে-প্রলোভনে, বিরাগে-অনুরাগে শাসকের ভয়ে কিংবা ভালোবাসায় ইনসাফের অপরিহার্য দাবিকে যারা গুরুত্ব প্রদান করতে বিমুখ ও পরান্মুখ, তাদের নসিব বড় খারাপ, তাদের পক্ষে মুসলমান থাকাই প্রায় অসম্ভব। কথাটা নিশ্চয়ই কঠিন; কিন্তু মনে রাখা আবশ্যক, ইনসাফের দাবিও গুরুতরভাবে কঠিন ও নিরাপদ। আল্লাহ পাক বলেন, ‘ইন্নাল্লাহা ইউহিব্বুল মুকসিতিন’Ñ আল্লাহ পাক নিশ্চয়ই সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন (সূরা হুজরাত-৯)। রাসূল সা: বলেন : বিচারক তিন ধরনের। এক, যারা প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও বিচারকের দায়িত্ব নিয়ে ভুল ফয়সালা প্রদান করে; দুই, বিচারকের আসনে বসে জেনেশুনে অন্যায়, অসত্য ও পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত বা ফয়সালা দান করে; এবং তিন, যারা সঠিক জ্ঞান রাখেন ও সঠিক ফয়সালা প্রদান করেন। প্রথম দুই শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামি; এবং শেষোক্ত শ্রেণী জান্নাতি, আখেরাতে যাঁরা নবী-রাসূলদের মতো মর্যাদা লাভ করবেন এবং আল্লাহ পাকের আরশের ছায়ায় হবে যাঁদের অবস্থান। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল সা:-এর কথা যেহেতু অকাট্য, বিচারকার্যক্রমের সাথে যারা যুক্ত তাদের এটা গভীরভাবে স্মরণ রাখা অত্যাবশ্যক যে, তাদের প্রদত্ত ফয়সালার কারণে তারা যেমন কেউ কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভে ধন্য হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন, অন্য দিকে অনেকের অবধারিত গন্তব্য হবে অগ্নিগর্ভ জাহান্নাম।

আমাদের বিচারব্যবস্থা এবং মাননীয় বিচারকদের সম্পর্কে বিশেষভাবে কিছু বলার নেই। সাধারণভাবে শুধু এটুকু বলা যায় যে, বিচার কোনো সাধারণ কর্ম নয়, বিচারকের আসনে যারা অধিষ্ঠিত, তাদের ওপর কঠিন গুরুভার অর্পিত। তিনি আল্লাহর ভয় দ্বারা চালিত এমন একজন মানুষ যিনি কর্তব্যকর্মে সর্বদা পক্ষপাতহীন ও নিরপেক্ষ এবং যেকোনো কঠিন চাপের মুখেও অনমনীয় দৃঢ়তা রক্ষা করতে সক্ষম; কোনো আশা ও আশাভঙ্গ তাকে বিচলিত করে না, ন্যায়বোধ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তিনি সর্বদা নিরপেক্ষ, তিনি পর্বতের মতো অটল ও ঋজু। এ ধরনের বিচারকই কোনো দেশের প্রকৃত গৌরব, সম্ভ্রম ও অহঙ্কার। বিচারকদের ভূমিকা ও লক্ষ্য কেমন হওয়া অত্যাবশ্যক, বেশি উদাহরণের প্রয়োজন নেই, রাসূল সা: কর্তৃক উপস্থাপিত একটি ঘটনাই যথেষ্ট। সম্ভ্রান্ত বংশের এক মহিলাকে চুরির অভিযোগে হাত কাটার দণ্ড প্রদান করা হলে সাহাবি রা:-এর কেউ একজন ভয়ে ভয়ে রাসূল সা:-এর কাছে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য উত্থাপন করলেন। রাসূল সা: সবাইকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন : এই অপরাধে যদি আমার কন্যা ফাতিমাও অভিযুক্ত হতো তারও হাত কাটা যেত। এটাই হলো ইনসাফ। ইনসাফের প্রশ্নে শত্রু-মিত্র, আপন-পর, ধনী-দরিদ্র, সম্ভ্রান্ত ও নিম্নবংশীয় এসব কোনো কিছুই ন্যূনতম প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করতে পারে না। এ জন্যই এখানে বিচারকের পক্ষে উদারতা প্রদর্শনেরও সুযোগ নেই, নির্মমতা কি কাঠিন্য প্রদর্শনেরও কোনো অবকাশ নেই। বিচারক হবেন ঋজু ও অচঞ্চল। তিনি হবেন, আল্লাহর ভয় ছাড়া সব ভীতি থেকে মুক্ত, বিরাগ-অনুরাগের অনেক ঊর্ধ্বে তার অবস্থান ধ্রুব নক্ষত্রের মতো নিরাবেগ। এ ধরনের বিচারকদের জন্যই রাসূল সা: অগ্রিম সুসংবাদ জ্ঞাপন করেছেন যে, তারা জান্নাতি, আখেরাতে তারা হবেন নবী-রাসূলদের মতো মর্যাদার অধিকারী।

পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই তাহলোÑ ইনসাফ শুধু দৃশ্যমান ফয়সালা মাত্র নয়; ইনসাফের সাথে অবিচ্ছেদ্য জড়িয়ে থাকে আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ এক মহিমান্বিত চেতনার সৌরভ, যা একজন বিচারককে সব লঘুত্ব ও পার্থিবতা থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে করে তোলে মহান আল্লাহ পাকের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি। ‘বিচারক’ নামে একটি ছায়াছবির কথা মনে পড়ছে। উত্তম-অরুন্ধতী অভিনীত এই ছবির একটি সংলাপ ‘  ‘Justice is no justice unless it is divine’’। এই কথা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কোনো বিচার ফয়সালার মধ্যে যদি Divine voice অর্থাৎ আল্লাহ পাকের কণ্ঠস্বর না থাকে তাহলে সেই বিচার কোনো বিচারই নয়। একেই রবীন্দ্রনাথ একটু অন্যভাবে বলেছেন, ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার’। অর্থাৎ দণ্ডদাতা বিচারক তার হৃদয়ের অন্তর্দেশে রক্ষা করবেন এক গভীর সর্বমানবিক মমতার প্রস্রবণ। অবশ্য এই কথার অর্থ এমন নয় যে, তার অপক্ষপাত দৃষ্টি, বিবেচনা ও ন্যায়বোধ কণামাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি অবতীর্ণ হবেন নিরপেক্ষ ভূমিকায়। সত্যকে সামনে রেখে যেকোনো ভয়ঙ্কর ঝুঁকি সত্ত্বেও একজন বিচারক থাকবেন সর্বদা সাহসী উচ্চারণে দৃঢ়পদ ও অকুতোভয়। তাই তথাকথিত নিরপেক্ষতার আচ্ছাদনে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে যারা সত্য প্রকাশে কুণ্ঠাগ্রস্ত ও নীরব, রাসূল সা: তাদেরকেই বলেছেন ‘বোবা শয়তান’। ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতালীয় কবি দান্তের অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য একটি কথা : ‘ভয়াবহ জাহান্নামের সর্বাধিক উত্তপ্ত স্থানগুলো নির্দিষ্ট আছে সেসব ব্যক্তির জন্য যারা কোনো নৈতিক সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে (Inferno : Divina Commedia)।’  আমাদের বিশ্বাস, এ কথা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সব বিচারকের ক্ষেত্রে বোধ হয় একটু বেশিই প্রযোজ্য।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গীতিকার
       

No comments

Powered by Blogger.