নারী আন্দোলন-বিপর্যয় পাড়ি দিয়ে পথ চলা by সালেহা বেগম

বাংলাদেশে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বেসরকারিভাবে এবং আশির দশক থেকে সরকারিভাবে 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস' পালন শুরু হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে ৩০-৩৫ বছর ধরে এ দিবস প্রতিপালিত হয়ে আসছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এ দিবস পালনে আনুষ্ঠানিকতার কোনো অভাব নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ দিবসের তাৎপর্য আমাদের সমাজে কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে অর্থাৎ নারীর সম-অধিকার বা ক্ষমতায়ন বিষয়ে আমরা কতটুকু সফল হয়েছি? এখন সময় এসেছে এক্ষেত্রে আমদের অর্জনগুলোকে খতিয়ে দেখার। বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, নারী ও পুরুষের সমতা অর্জনে আমাদের দেশকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এরপরও বলা যায়, বিগত বছরগুলোতে কিছু অর্জন আমাদের রয়েছে। প্রথমত, রাজনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের পার্লামেন্টে শতকরা ১০ ভাগ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদে শতকরা ৩০ ভাগ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত আছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে নারীরা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। আমাদের এ অঞ্চলে নারীরা রাজনীতিতে শীর্ষ পদে সরাসরি আসছেন ঠিকই তবে তাদের নিকটাত্মীয় তথা খ্যতিমান পিতা বা স্বামীর ইমেজ এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদেও নারীদের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সাম্প্রতিক সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি হিসেবে নাজমুন আরা সুলতানার নিয়োগ নারীর ক্ষমতায়নে আরও একটি মাত্রা যোগ করেছে। ব্যবসায় নেতৃস্থানীয় পদে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে ধীরলয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ক্রমান্বয়ে। উলি্লখিত তথ্যগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে শহর এলাকার উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত নারীদের অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে। আমাদের শহরের নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং গ্রামের নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে সামাজিক সচেতনতা, মানবাধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বলতে গেলে কোনো ধারণাই নেই। তারা নিজেদের সমাজ ও পরিবারের বোঝা হিসেবে মনে করে। তাদের নিজস্ব কোনো চিন্তা, পছন্দ, মতামত থাকতে পারে, তা তারা ভাবতেই পারে না। এর ফলে সমাজে ঘটছে নানা অনাচার। নারীরা আজও চরম লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে ফতোয়াবাজদের ফতোয়ার মাধ্যমে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষিত হেনাকে দোররা মেরে হত্যার কাহিনীর দগদগে ক্ষত বুকে নিয়ে আমাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এ দোররা মারার বিধান দিয়েছিলেন সমাজপতিরাই। হেনার আগেও অনেক নারীকেই এভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। এছাড়াও এসিড-সন্ত্রাস, যৌন নির্যাতনের কারণেও প্রাণ দিয়েছেন বহু নিরপরাধ নারী। অনেকে আবার বেঁচে থেকেও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বহু বিপর্যয়ের পথ পার হয়ে নারীরা আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। এ সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য মূলত সামাজিক ও মানবিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে সমাজের নারী-পুরুষ সবার সংঘবদ্ধ উদ্যোগ ও সমবেত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রথম কাজটিই হবে সবার নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পন্ন করা।
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে বিভিন্ন নারী সংগঠন নারী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তারপরও সম্ভবত কোনো কৌশলগত কারণে সমস্যাগুলো সঠিকভাবে দূরীভূত হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টজনের মতামত আলোচনা-পর্যালোচনার আলোকে কর্মকৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের পথ খুঁজে অতীতের ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিহার করে সামনে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। একবিংশ শতাব্দীতে আমরা নারীদের সুস্থ, স্বাভাবিক ও সাবলীল এবং সম্মানজনক জীবনযাপনের উপায় খুঁজে বের করার আত্মপ্রত্যয় গ্রহণ করতে পারি।

সালেহা বেগম : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

No comments

Powered by Blogger.