মৃত্যুঞ্জয়ী স্যামসন এইচ চৌধুরী by এবিএম ফজলুর রহমান

সততা, নিষ্ঠা, শ্রম, মেধা ও শৃঙ্খলা একজন মানুষকে কত ওপরে নিয়ে যেতে পারে তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্কয়ার গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরী। যিনি প্রচণ্ড আস্থা ও মনোবলকে পুঁজি করে শূন্য থেকে শিখরে পেঁৗছেছিলেন।
এ দেশের শিল্প ও ব্যবসায় যার অবদান প্রশংসনীয়। প্রতিকূল অবস্থাকে পাশ কাটিয়ে শূন্য থেকে স্কয়ার গ্রুপ যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশের মধ্যে শীর্ষে উঠে এসেছেন তিনি হলেন প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী। ছোটবেলায় গাছগাছালি, লতাপাতা নিয়ে খেলা ছিল যার অভ্যাস। হামানদিস্তায় লতাপাতা পিষে খেলার ছলে ওষুধ বানিয়ে মজা পেত। মানুষের হাত-পা কেটে গেলে গাছের পাতা ছেচে লাগিয়ে দিত। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। সে সুবাদেই ওষুধ তৈরির প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রচুর। লেখাপড়া শেষ করে কিছুদিন চাকরি করেছেন। ভালো লাগল না। বাবাকে বললেন টাকা দাও, ব্যবসা করব। বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে একটি ফার্মেসি খুললেন। চিকিৎসায় বাবার খুব সুনাম ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসত। এক সময় দেখলেন এমবিবিএস ডাক্তারের প্রতি রোগীরা বেশি ঝুঁকছে। তার এক বন্ধু ডাক্তার ছিল। তখন ওই ডাক্তারকে গিয়ে বলা হলো হাটবারের দিন ফার্মেসিতে বসতে হবে। ফার্মেসি ব্যবসা বেশ জমে উঠল। এভাবে ওষুধ বিক্রি করতে করতেই হঠাৎ একদিন মাথায় চিন্তা এলো। আমরা তো ওষুধ তৈরি করতে পারি। যে কথা সেই কাজ। চার বন্ধু এক সঙ্গে মিলে শুরু করল ওষুধ তৈরির কাজ। ২০-২৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ওষুধ তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। দেড় বছরে তাদের পুঁজি বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার টাকা। আর চার বছর পর মুনাফা করতে শুরু করেন। এই সফল ও স্বপ্নের গল্প স্কয়ার গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরীর।
প্রথমে নিজে বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করেন 'ই-সনস' নামক ওষুধ তৈরির কারখানা। পরে বাবার কাছ থেকে পুঁজি নিয়ে নেমে পড়েন ফার্মেসি ব্যবসায়। চার বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস নামে প্রথম ওষুধ কারখানা।
স্কয়ার বাংলাদেশে আজ এক আস্থার প্রতীক। এটি আজ বাংলাদেশে শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ। আর এর স্বপ্নদ্রষ্টা স্যামসন এইচ চৌধুরী। ৫৫ বছর আগে স্যামসন এইচ চৌধুরীর নেতৃত্বে চার বন্ধু মিলে পাবনা শহরে শালগাড়িয়া এলাকায় যে ছোট্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটি আজ মহীরুহ। ১৯৫৮ সালে যে প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্কয়ারের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার নাম ছিল স্কয়ার ফার্মা।
১৯৮৮ সাল থেকে ওষুধের পাশাপাশি স্কয়ার গ্রুপ নতুন শিল্প স্থাপন শুরু করে। ওই সময়ে স্কয়ার ফার্মার একটি আলাদা বিভাগ হিসেবে স্থাপন করা হয় স্কয়ার ট্রয়লেট্রিজ লিমিটেড। ১৯৯৫ সালে স্কয়ার টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ শুরু করে। স্কয়ারের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ টেক্সটাইল খাতে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কনজিউমার পণ্য। এ দুটি খাতে তাদের প্রবৃৃদ্ধির হার ঈর্ষণীয়।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী স্যামসন এইচ চৌধুরী ১৯২৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার কাশিয়ানী থানার আড়ূয়াকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন ইয়াকুব হোসেন চৌধুরী। স্যামসন চৌধুরী ভারতে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫২ সালে পাবনা জেলার আতাইকুলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে স্কয়ার ফার্মায় ২৮ হাজারসহ স্কয়ার গ্রুপের ৪৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি, মাইডাসের চেয়ারম্যানসহ নানা পদ অলঙ্কৃত করেন তিনি। স্যামসন চৌধুরী ১৯৯৮ সালে আমেরিকান চেম্বার কর্তৃক বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্য ইয়ার, ২০০০-০১ সালে ডেইলি স্টার এবং ডিএইচএল কর্তৃক বেস্ট এন্টারপ্রেনার অব দ্য কান্ট্রি, ২০০৩ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড, ২০০৫ সালে ব্যাংকার্স ফোরাম অ্যাওয়ার্ড ও ২০০৬ সালে আইসিএবি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে পরপর দু'বছর দেশের সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরে তিনি পরলোকগমন করেন।

No comments

Powered by Blogger.