জ্বালানি তেল- বোরো চাষিরা বিপাকে প্রভাব পড়বে বাজারে by অরুণ কর্মকার

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ১০০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার পেতেই মূলত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বোরো চাষিরা। প্রভাব পড়বে পরিবহন খাতেও। ফলে বাড়বে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়।
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো এমন দিনে, যে সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক সংকট মেটাতে নতুন বিল অনুমোদন পাওয়ার প্রভাবে গতকাল শুক্রবার বিশ্বের সব কটি বাজারেই তেলের দামে ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। ২০১৩ সালের সব কটি পূর্বাভাসও বলছে, এ বছর তেলের দাম বাড়ছে না।
আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে সরকারের সাশ্রয় হবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে নির্বাচনী বছরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এ জন্য বাড়তি যে অর্থ দরকার, সরকার এবার
তার সংস্থান করছে জ্বালানি তেলে দেওয়া ভর্তুকি কমিয়ে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সরকার অর্থ নিচ্ছে সরাসরি, কিন্তু এর উপকার মানুষ পাবে পরোক্ষভাবে। আবার এভাবে অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতাও অপেক্ষাকৃত কম। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এভাবে অর্থ ব্যয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, দলীয় নেতা-কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া ও ভোটার সংগঠিত করা।
সরকার গত বৃহস্পতিবার রাতে ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ থেকে সাত টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। দাম বাড়ানোর ঘোষণাসংক্রান্ত সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘আর্থিক শৃঙ্খলা ও প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রমসহ সরকারের অন্যান্য আবশ্যকীয় সামাজিক নিরাপত্তাজনিত ব্যয়সমূহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার স্বার্থে’ দাম বাড়ানো হয়েছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোনো খাতের ভর্তুকি তুলে নেওয়া যেমন একটি পদ্ধতি হতে পারে, তেমনি ভর্তুকি বহাল রাখা কিংবা বাড়ানোও একটি পদ্ধতি হতে পারে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় বিষয় হবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
কৃষিতে প্রভাব: কৃষিতে ব্যবহূত ডিজেলের জন্য কৃষককে সরকার নগদ ভর্তুকি দেয়। এ বছর বোরো চাষে কৃষকের জন্য ভর্তুকির যে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে, তার সঙ্গে ডিজেলের বর্ধিত দাম সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিজেলের দাম বাড়ানোর ফলে ওই ভর্তুকি বাড়ানোর কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেয়নি।
অর্থাৎ এবার বোরো চাষে কৃষকের ব্যয় বাড়বে। তাই তাঁকে টিকে থাকতে হলে কৃষিপণ্যের দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু সেই দাম বাড়ানোর উপায় কৃষকের হাতে নেই। এমনিতেই কৃষিপণ্যের, বিশেষ করে খাদ্যশস্যের দাম কম হওয়ায় কৃষকদের প্রণোদনার একটা অভাব রয়েছে। তার ওপর ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও তার ভর্তুকি বাড়ানো না হলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বিদ্যুৎ, শিল্প, পরিবহন: ভর্তুকির চাপ বৃদ্ধির একটি বড় কারণ তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সরকারি এক হিসাব অনুযায়ী ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় ২০১১-১২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের বাড়তি ব্যয় হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ছয়বার দাম বাড়িয়েও এ ক্ষেত্রে ঘাটতি মেটানো যায়নি। ফলে সরকারের ভর্তুকির ওপর একটি দুঃসহ চাপ রয়েছে।
ডিজেল ব্যবহারকারী শিল্পেও উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। উৎপাদকেরা তাঁদের পণ্যের দামও বাড়াবেন। সেই পণ্য বাড়তি দামে কিনতে হবে কৃষক, দোকানদার এবং সীমিত আয়ের সব শ্রেণীর সাধারণ মানুষকে।
ডিজেলচালিত ট্রাকের ভাড়া বাড়বে। বাড়বে ট্রাকবাহী সব পণ্যের দামও। বাড়তি দামেই সেই পণ্য কিনতে হবে মানুষকে। বাস-লঞ্চ-স্টিমারের ভাড়াও বাড়ার কথা। যদি বাড়ে, সেই বাড়তি ভাড়াও গুনতে হবে সব শ্রেণীর মানুষকে। আর যদি অতীতের মতো এগুলো অনানুপাতিক হারে বাড়ে, তাহলে তা সাধারণ মানুষকে বেশ দুর্ভোগে ফেলবে।
সাধারণ মানুষ: ঢাকার কাঁচাবাজার ও বিপণিবিতানগুলোতে লোডশেডিংয়ের সময় জেনারেটরের বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরা গতকালই নোটিশ পেয়েছেন। প্রতিদিন ব্যবহার সাপেক্ষে তাঁদের বিদ্যুৎ বিল বাবদ দুই থেকে পাঁচ টাকা বেশি দিতে হবে। কারণ, ডিজেলের দাম বেড়েছে। কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে এবং নিউমার্কেট ও গাউছিয়া থেকে এ খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকার বাইরেও অসংখ্য হাট-বাজারে সব শ্রেণীর দোকানদার জেনারেটরের বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। যেখানে গ্রিডের বিদ্যুৎ আছে সেখানেও বিকল্প হিসেবে জেনারেটর রাখা হয় লোডশেডিংয়ের সময় বেচাকেনা অব্যাহত রাখতে। তাঁদেরও বিল বেড়ে যাচ্ছে একই হারে। এরপর তাঁরা এই বাড়তি ব্যয়ের চাপ স্থানান্তর করবেন গ্রাহকের ওপর এবং তা হবে অনানুপাতিক হারে।
অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা: মূল্যবৃদ্ধিসংক্রান্ত তথ্য বিবরণীতে সরকার ভারত ও পাকিস্তানে জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখ করে দেশে দাম বাড়ানোর যুক্তি দিয়েছে। এটা কতটা যৌক্তিক জানতে চাইলে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটা একেক দেশের অর্থনীতির সামর্থ্য, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে। তাই একাধিক দেশকে একভাবে বিবেচনা করা যায় না।
সব মিলিয়ে অতীতের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, জ্বালানির দাম যে হারে বাড়ানো হয়. এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতে (যোগাযোগ, পরিবহন, শিল্পপণ্য প্রভৃতি) দাম বাড়ানো হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে জনগণের ব্যয় অনেক বেশি হারে বৃদ্ধি পায়। এতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এই আশঙ্কাই এখন করা হচ্ছে। দেশে খাদ্যসূচকে মূল্যস্ফীতি কমলেও খাদ্যবহির্ভূত সূচকে তা প্রায় ১১ শতাংশ। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা লাফ দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.