সিপিডির পর্যালোচনা- অর্থ পাচার অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে

দেশ থেকে প্রতিবছর বিভিন্নভাবে বিশাল অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, অর্থ পাচার অর্থনীতিতে নতুন ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
রাজনৈতিক চক্রের সঙ্গে অর্থ বাইরে চলে যাওয়ার একটা যোগ রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনার জন্য সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তিনি এ সময় আরও বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আপাতদৃষ্টিতে সরকারের সঙ্গে প্রাক-সমঝোতা বলেই মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে, দুদকের নেওয়া ব্যবস্থা বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি।’
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালক রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয় মন্তব্য করে সিপিডির এই গবেষক বলেন, ‘পরিচালক নিয়োগে চরম রাজনীতিকীকরণের ফল কী হতে পারে, তা সাম্প্রতিক হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।’
অনুষ্ঠানে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা প্রতিবেদন তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির গবেষণা প্রধান ফাহমিদা খাতুন, জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ।
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গ: পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির মামলা থেকে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে কি না, জানতে চাইলে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়টি বড় নয়। আমি যেটি দেখছি সেটি হলো, বাংলাদেশের রুলস অব বিজনেসে কাজের ক্ষেত্রে সচিবদের জায়গায় মন্ত্রীদের প্রধান নির্বাহী করা হয়েছে। তাই মন্ত্রণালয়ের অধীনে কোনো কাজ হবে আর তা মন্ত্রী জানবেন না, তা হয় না। তা ছাড়া এ মুহূর্তে যেসব আলাপ-আলোচনা আসছে, তাতে শুধু সচিব নয়, আরও ওপরের কোনো মানুষের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। তবে এটি নিঃসন্দেহে তদন্ত এবং আরও গভীর বিশ্লেষণের বিষয়।’
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুতে এখন পর্যন্ত অর্থায়ন না হওয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার একটি বড় সংকেত।
অর্থ পাচার: সিপিডি বলেছে, ইউএনডিপির হিসাবে প্রতিবছর গড়ে এ দেশ থেকে ৩১০ কোটি ডলার এবং গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) হিসাবে, ১৪০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে। তখন সরকার বদল হচ্ছিল কিংবা অন্য রকম একটা সরকার ছিল। এর পর বেশি পাচার হয়েছে ২০১০ সালে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক চক্রের সাথে অর্থ বাইরে চলে যাওয়ার একটা যোগ রয়েছে।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাচার ঠেকাতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। অর্থ পাচারের পথগুলো বন্ধ করার ওপর জোর দেন তিনি।
পরিচালক নিয়োগে রাজনীতিকীকরণ: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে সিপিডির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এটি এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্ভরশীল ও গ্রহণযোগ্য কোনো জায়গায় নেই। এখনো রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ করা হচ্ছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘কী যোগ্যতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ করা হচ্ছে, তার স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য কোনো মাপকাঠি নেই। ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগকে কেন্দ্র করে এখন একটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। সেটি হলো, নিয়োগের এ ক্ষমতা আসলে কার। বাংলাদেশ ব্যাংকের নাকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নাকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের। তা ছাড়া কে পরিচালক মনোনয়ন দেবেন, সে বিষয়ে কোনো উচ্চক্ষমতার কমিটিও নেই। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সরকারের নির্বাহী বিভাগ এ কাজটি করছে। কিন্তু আমাদের দাবি হলো, এ ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা হোক। আর পরিচালক নিয়োগের যোগ্যতার একটি গ্রহণযোগ্য মাপকাঠি নির্ধারণ করা হোক।’
হল-মার্কের অর্থ কেলেঙ্কারির বিষয়ে সিপিডি বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংক থেকে হল-মার্ক যে অর্থ নিয়ে গেছে, তা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ করা অর্থের প্রায় ১৬ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও সুশাসনের অভাবে এ ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে।
অচল পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা: নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অভাবে সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অচল হয়ে গেছে বলে মন্তব্য দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের। তিনি বলেন, ‘এ দলিলটি ছিল সরকারের জন্য অত্যন্ত যৌক্তিক, রাজনৈতিকভাবে চিন্তাশীল এবং সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয়। সরকার যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, সেগুলোর প্রতিফলন ঘটেছিল এ পরিকল্পনায়। তবে এখন এ পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রার প্রাক্কলনগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। কারণ, যেসব অনুমানের ভিত্তিতে প্রাক্কলনগুলো করা হয়েছিল, সেসব অনুমানের অনেকগুলো বড় জায়গা বাস্তবায়িত হয়নি। তাই এ পরিকল্পনাকে এখন সংশোধন ও পরিমার্জন করা উচিত।’

No comments

Powered by Blogger.