ট্রাইব্যুনালে দশম সাক্ষী-সাঈদীর কথায় কুট্টিকে গুলি করে মারে পাকিস্তানি সেনারা

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের দশম সাক্ষী বাসুদেব মিস্ত্রি (৫৪) বলেছেন, একাত্তরে পিরোজপুরের চিথলিয়া গ্রামের ইবরাহিম ওরফে কুট্টিকে সাঈদীর কথায় পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। মানিক পসারির বাড়িতে আগুন দেওয়ার পর রাজাকাররা মফিজ ও কুট্টিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। পথে সাঈদীর কথায় পাকিস্তানি সেনারা কুট্টিকে গুলি করে। বাসুদেব মিস্ত্রি গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া


জবানবন্দিতে এ কথা বলেন। সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী সুলতান আহমেদ হাওলাদার, ষষ্ঠ সাক্ষী মানিক পসারি ও সপ্তম সাক্ষী মফিজউদ্দিন পসারিও তাঁদের জবানবন্দিতে প্রায় একই কথা বলেছিলেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হাজির করা হয়। শুরুতে বাসুদেব জবানবন্দি দেন। বাসুদেব বলেন, একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল ১৩-১৪ বছর। তাঁর বাবা মানিক পসারির বাড়িতে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন, তিনি তাঁকে সহযোগিতা করতেন।
জবানবন্দিতে বাসুদেব বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দু-তিন মাস পর দেলু শিকদার (সাঈদী), সেকান্দার শিকদার, দানেশ মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, রুহুল আমিন, হাকিম ক্বারি, মমিনসহ আরও অনেকে পারেরহাট ইউনিয়নে রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। একাত্তরের ৮ মে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে ওই রাজাকাররা মানিক পসারির বাড়ি যায়। রাজাকারদের আসার খবর পেয়ে বাড়ির প্রায় সব লোক পালিয়ে যায়। কিন্তু মফিজ ও কুট্টি বাড়িতে রয়ে যান। রাজাকাররা তাঁদের ধরে একসঙ্গে বেঁধে ফেলে। বাড়ি লুট করার পর সাঈদী আগুন ধরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তারপর কুট্টি ও মফিজকে নিয়ে রাজাকাররা তাদের পারেরহাট ক্যাম্পের দিকে রওনা দেয়। বাসুদেব বলেন, যাওয়ার পথে সেতুর ওপর উঠে সাঈদী এক পাকিস্তানি সেনাকে কিছু একটা বললে তারা বাঁধন খুলে কুট্টিকে ঘাটে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর মফিজকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে।
বাসুদেব ট্রাইব্যুনালকে জানান, মফিজ পরে রাজাকার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে তাঁকে এসব ঘটনা বলেছিলেন। বাসুদেব আরও বলেন, সাঈদীর নেতৃত্বে তাঁরসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের বাড়িঘর রাজাকাররা পুড়িয়ে দিয়েছিল।
জবানবন্দি শেষ হলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোখলেসুর রহমান সাক্ষী বাসুদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, দেলু শিকদার অথবা সাঈদীকে তিনি চিনতে পারেন কি না। কাঠগড়ায় বসা সাঈদীকে দেখে সাক্ষী তাঁকে চেনেন বলে জানান।
এরপর সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। তিনি জানতে চান, রাজাকার রুহুল আমিন কি বেঁচে আছেন এবং বাসুদেব তাঁকে চেনেন কি না। জবাবে সাক্ষী বলেন, রুহুলকে তিনি চেনেন। তিনি বর্তমানে পিরোজপুর আদালতে ওকালতি করেন। বাড়ি পিরোজপুরের গাজীপুর গ্রামে। মিজানুল জানতে চান, মানিক ও তাঁর বাবা সইজউদ্দিন পসারিসহ বাড়ির লোকজন পালিয়ে যাওয়ার সময় কুট্টি ও মফিজ বাড়িতে ছিলেন কি না। জবাবে বাসুদেব হ্যাঁ বলেন। তখন মিজানুল প্রশ্ন করেন, বাসুদেব কখন ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন? সাক্ষী বলেন, সকালে হাত-মুখ ধুয়েই তিনি সেখানে কাজ করতে যান।
জেরার একপর্যায়ে মিজানুল জানতে চান, ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসার পর মফিজের সঙ্গে সাক্ষীর দেখা হয়েছিল কি না। জবাবে সাক্ষী বলেন, দেশ স্বাধীনের পর দেখা হয়েছিল। এর আগে দেখা হয়নি। আরেক প্রশ্নে মিজানুল জানতে চান, একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা বাসুদেবের মনে আছে কি না। জবাবে সাক্ষী বলেন, এটা তাঁর মনে নেই।
দুপুর ১২টার দিকে সাক্ষী অসুস্থ বোধ করায় বেলা দুইটা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে বিরতি দেওয়া হয়। কার্যক্রম আবার শুরু হলে মিজানুল সাক্ষীর বাড়ির আশপাশে কার বাড়ি ছিল তা জানতে চান। তিনি আরও জিজ্ঞেস করেন, কবি সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, এ এফ এম মেসবাহউদ্দিন ও শাহরিয়ার কবির—এই চারজন বা তাঁদের কোনো প্রতিনিধি সাঈদীর বিষয়ে জানতে সাক্ষীর কাছে গিয়েছিলেন কি না। জবাবে সাক্ষী বলেন, তাঁদের তিনি চেনেন না।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী কফিলউদ্দিন চৌধুরী সাক্ষীকে জেরা করেন। তিনি জানতে চান, সাক্ষী ঘড়ির সময় ধরে চলাচল করেন কি না। সাক্ষী বাসুদেব বলেন, তিনি ঘড়ি নয়, সূর্য দেখে চলেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে বাসুদেব বলেন, পাকিস্তানি সেনারা মানিক পসারির বাড়ির গোয়ালঘরে আগুন দেয়নি। আর গরু-মহিষ চরে ছিল বলে নিতে পারেনি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোসলেম মাওলানা ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের শিক্ষক ছিলেন কি না, তা তিনি জানেন না।
বিকেল চারটার দিকে সাক্ষীকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মনজুর আহমেদ আনসারী। তিনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সাক্ষীর দেওয়া জবানবন্দি এবং এদিন (রোববার) ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দির মধ্যে ‘বৈপরীত্য’ নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। জেরার শেষ পর্যায়ে মনজুর বলেন, বাসুদেব দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকার কারণে কোনো কাজ করতে না পারায় স্থানীয় সাংসদ তাঁকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আশ্বাসে সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পাঠিয়েছেন। তবে সাক্ষী এর বিরোধিতা করে বলেন, এ কথা সত্য নয়।
সাড়ে চারটার দিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বাসুদেবকে জেরা শেষ করেন। পরে ট্রাইব্যুনাল আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.