সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমছে না by আনোয়ার হোসেন

ড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু কমছে না। প্রতিদিন গড়ে ৫৫ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং বিআরটিএর সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সেলগুলো দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর কিছু করতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকের ভুলের কারণেই বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। অথচ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট এক লাখ ৮৯ হাজার পেশাদার চালকের লাইসেন্স


দিয়েছে কোনো ধরনের যোগ্যতার পরীক্ষা ছাড়া। দুর্ঘটনার জন্য চালকের শাস্তি নগণ্য। দীর্ঘদিনের নাগরিক দাবি—আইন সংশোধন করে শাস্তি বাড়ানোর। কিন্তু সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) দুর্ঘটনাপ্রবণ ২১৬টি স্থান নির্ধারণ করে প্রতিকারের সুপারিশ করেছে দুই বছর আগে। ওই সুপারিশ বাস্তবায়নেও কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী নয়।
গত বছরের আগস্টে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার পর গঠিত তদন্ত কমিটি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তার কোনো সুপারিশ বাস্তবায়নের কথাও কেউ শোনেননি।
এআরআইয়ের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি হিসাবে গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা বেড়েছে। পুলিশ বাড়তি দায়িত্ব এড়ানোর জন্য দুর্ঘটনার হিসাব রেকর্ডভুক্ত করে না। তিনি বলেন, সদিচ্ছা থাকলে অর্থ ব্যয় না করেই ২৫ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। বাকিটার জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা ও বিনিয়োগ কোনোটিই নেই।
পরিসংখ্যান: সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। বছরে গড়ে মানুষ মারা যায় তিন হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে, এমন দুর্ঘটনা হিসাবে নিয়ে পুলিশ এই তথ্য দিয়েছে। বেসরকারি হিসাবে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যায় প্রায় ৫৫ জন।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, পুলিশ দুর্ঘটনা ও হতাহতের যে হিসাব দেয়, প্রকৃত সংখ্যা তার কয়েক গুণ। দুর্ঘটনার পর পুলিশকে ৬৭ ধরনের প্রশ্ন সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এই ঝামেলা এড়াতে তারা অনেক দুর্ঘটনা রেকর্ডভুক্ত করে না।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সংঘটিত দুই হাজার ২৪১টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় দুই হাজার ১৪০ জন। মারাত্মক আহত হয় এক হাজার ১৮৬ জন। সামান্য আহতের সংখ্যা ১৫৭।
পুলিশ ও হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বিআরটিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭২ হাজার ৭৪৮টি। মারা গেছে ৫২ হাজার ৬৮৪ জন। আহত বা পঙ্গু হয়েছে আরও কয়েক হাজার মানুষ।
পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, আইন প্রয়োগের কারণে গত তিন বছরে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার দুটিই কমেছে। তিনি বলেন, মোটরযান আইনে শাস্তির বিধান কম। তাই আইন অমান্য করার প্রবণতা বেশি। আইনটি যুগোপযোগী করা হলে চালকসহ সবার মধ্যে ভয় কাজ করবে।
আইন দুর্বল: সড়ক দুর্ঘটনাকে নরহত্যা হিসেবে গণ্য করে দায়ী চালকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার আইন করা হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে সরকার সে আইন সংশোধন করে। এখন চালকের ভুলে দুর্ঘটনা হলে এক থেকে তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে। আইনটি যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে একটি কমিটি করেছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। খসড়াও হয়। কিন্তু এখনো খসড়াটি আইনে পরিণত হয়নি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পের অধীনে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড আইনটি যুগোপযোগী করার কাজ শুরু করেছে। খসড়াও একটি হয়েছে। তবে এটি বাতিলের দাবিতে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে মালিক-শ্রমিকেরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছে গত অক্টোবরে।
চালকের ভূমিকা: বুয়েটের তিন শিক্ষক ২০০৬ সালে সড়ক নিরাপত্তায় চালকদের ভূমিকা বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালান। তাতে বলা হয়, ৬০ শতাংশ চালকই জীবনে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে বেরিয়ে আসে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী চালকেরাই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটান। এই বয়সের চালকের ৪১ দশমিক ২ শতাংশ প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
এ ছাড়া ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী চালকদের মধ্যে ৩২ দশমিক ৮ এবং ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী চালকদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় জড়িত ছিলেন।
বাংলাদেশে মৃত্যুর হার বেশি: সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০৯ সালে এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটি তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করে। তাতে মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ ছিল দ্বিতীয়। নেপাল ছিল প্রথম। ওই চিত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুর্ঘটনায় মারা যায় ৬০ জন মানুষ। নেপালে মারা যায় ৬৩ জন। সবচেয়ে কম মারা যায় যুক্তরাজ্যে, ১ দশমিক ৪ জন।
কর্মক্ষম ব্যক্তিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত: যুক্তরাজ্যভিত্তিক ট্রান্সপোর্ট রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৫ শতাংশের সমান। ওই গবেষণায় দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের প্রায় ৩২ শতাংশ ১৬ থেকে ৩২ বছর বয়সের মধ্যে।
গ্লোবাল রোড সেফটি পার্টনারশিপের (জিআরএসপি) এক প্রকাশনা থেকে জানা গেছে, হাসপাতালের বিছানার ২৫-৩০ ভাগই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়। দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের সুস্থ হতে গড়ে ৩৫ দিন লাগে।

No comments

Powered by Blogger.