চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চে খালেদা জিয়া-তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল সরকারকেই করতে হবে by হাসান শিপলু ও শাহজালাল রতন

রকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, নিজেদের অধীনে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ মস্ত বড় ভুল করবে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল না করে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংলাপকে 'ভাঁওতাবাজি' বলে অভিহিত করেন তিনি। খালেদা


জিয়া জানান, চট্টগ্রামের রোডমার্চ থেকে সরকার পতনের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করবেন তিনি। খালেদা জিয়া হুশিয়ারি দেন, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। আওয়ামী লীগ এবার যে অপকর্ম করেছে তাতে আওয়ামী লীগ ৪১ বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
গতকাল রোববার চট্টগ্রাম অভিমুখে বিএনপির রোডমার্চের জনসভা এবং পথসভায় তিনি এসব কথা বলেন
চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চের প্রথম দিন গতকাল ২৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে দলীয় নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি। বিকেলে ফেনী পাইলট হাইস্কুল মাঠে চার দলের উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে গতকাল কুমিল্লার চান্দিনার মাধাইয়া মুক্তিযোদ্ধা কলেজ মাঠ, ছয়ঘড়িয়ার তুলাতলি মাঠ এবং পদুয়ার বাজার রেলওয়ে সংলগ্ন মাঠে পথসভা হয়।
ফেনীর জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন, এখন আর ঘুমিয়ে থাকার সময় নেই। সরকারকে বিদায় করতে চট্টগ্রামের জনসভা থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। সে কর্মসূচি আওয়ামী লীগের মতো জ্বালাও-পোড়াও নয়, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাবে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের অপকর্মের কারণে '৯৬ সালে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেছিল। এবার যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে, তাতে আগামী ৪১ বছরেও তারা আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে তরুণ, নবীন ও প্রবীণদের সমন্বয়ে দেশ পরিচালনা করা হবে।
ফেনীর জনসভার আগে সার্কিট হাউসে বিশ্রাম নেন খালেদা জিয়া। সেখান থেকে রাত ১০টায় চট্টগ্রামে পেঁৗছলে বিশাল শোডাউন করে নেতাকর্মীরা তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাত যাপন করেন। আজ সোমবার বিকেলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পলো গ্রাউন্ড মাঠে জনসভার মাধ্যমে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটবে।
এর আগে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে গুলশানের নিজ বাসভবন থেকে রওনা করেন খালেদা জিয়া। পৌনে ১১টায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের নেতৃত্বে চার সহস্রাধিক গাড়িবহর চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। পথে পথে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন, শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ শোডাউন করেন। তিনটি পথসভা শেষে সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় ফেনী এসে পেঁৗছান খালেদা জিয়া। সোয়া ৭টায় খালেদা জিয়া যখন পাইলট স্কুল মাঠে পেঁৗছান তখন আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। দুপুরের আগ থেকেই বৃহত্তর নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী আসেন স্কুলমাঠে। বিকেল না গড়াতেই আশপাশ এলাকা লোকারণ্য হয়। লক্ষাধিক লোকের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ৪০ মিনিট বক্তৃতা করেন তিনি।
বিরোধীদলীয় নেতার গাড়িবহর ১২টা ৪৫ মিনিটে কাঁচপুর ব্রিজ অতিক্রম করে। চান্দিনার মাধাইয়া পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টা। বিশাল গাড়িবহরের জন্য জনগণকে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিতে ২৭ অক্টোবর নয়াপল্টনে চার দলের সমাবেশ থেকে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া। এর আগে ১০ ও ১১ অক্টোবর সিলেট, ১৮ ও ১৯ অক্টোবর উত্তরবঙ্গ এবং ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দক্ষিণবঙ্গ অভিমুখে রোডমার্চ হয়। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও রোডমার্চ করেছিল দলটি। কর্মসূচিতে জোটের শরিক, সমমনা দল ও নতুন মিত্রসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
আশঙ্কা করা হলেও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই রোডমার্চের প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে। ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থেকে ফেনী পর্যন্ত পথে পথে নেতাকর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত হন বিরোধীদলীয় নেতা। রাস্তার দু'ধারে হাজার হাজার নেতাকর্মী তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারীকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এ সময় তাদের হাতে ছিল লাল-নীল পতাকা। ড্রাম বাজিয়ে, খালেদা জিয়ার নামে স্লোগান দিয়ে রোডমার্চকে উৎসাহ জোগান তারা। জামায়াতও শোডাউন করেছে।
চান্দিনায় দ্বিতীয় পথসভায় খালেদা জিয়া বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নিজেদের অধীনে নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ মস্ত বড় ভুল করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া ওই রকম নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল অংশ নেবে না এবং তা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নিলে ভুল করবে। এর জবাবে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, 'আমরা নই, আপনারা নিজেদের অধীনে নির্বাচন করলে বড় ভুল করবেন। এতে দেশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। এ জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।'
এর আগে দুপুুর পৌনে ৩টায় চান্দিনার মাধাইয়া মুক্তিযোদ্ধা কলেজ মাঠে প্রথম পথসভায় বক্তব্য রাখেন খালেদা জিয়া। এতে তিনি বলেন, সরকার হটানো ছাড়া মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটবে না।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতিম লীর সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদ ও চান্দিনার ছয়ঘড়িয়ার তুলাতলি মাঠে বিএনপি কুমিল্লা জেলা উত্তরের সভাপতি খোরশেদ আলমের সভাপতিত্বে দুটি পথসভায় বক্তব্য রাখেন খালেদা জিয়া। এ ছাড়া নিমসার বাজার এবং ব্রাহ্মণপাড়ার বুড়িচংয়ে অনির্ধারিত দুটি পথসভায় বক্তব্য রাখেন তিনি।
ফেনীর জনসভায় স্থানীয় সাংসদ খালেদা জিয়া বলেন, সরকারের দুর্নীতির ফিরিস্তি তাদের হাতে আছে। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে।
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুর সভাপতিত্বে এবং সাংসদ রেহানা আক্তার রানুর পরিচালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, এলডিপি সভাপতি অলি আহমদ, যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাৎ হোসেন সেলিম, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাংসদ বরকতউল্লা বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, মাহবুবউদ্দিন খোকন, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আবুল খায়ের ভঁূইয়া, এবিএম আশরাফ উদ্দিন নিজান, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, রেহানা আক্তার রানু, শাহানা আখতার সানু প্রমুখ।
জনসভায় ৪০ মিনিট স্থায়ী বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা অপশাসন, দুর্নীতি, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, গুপ্তহত্যাসহ সরকারের ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনা করেন। পাশাপাশি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, গ্রামকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, সরকার প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সব উজাড় করে দিচ্ছে। সীমান্ত হত্যারও প্রতিবাদ করছে না। তারা বোকা ও অবুঝ হয়ে গেছে। তাদের দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়।
রাত ১১টা ২০ মিনিটে খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পেঁৗছেন। চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতারা তাকে স্বাগত জানান।

No comments

Powered by Blogger.