ত্রুক্রয়েল টু বি কাইন্ড-সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ by জিল্লুর রহমান খান

টা মনে রাখতে হবে যে, সমাজের সব অংশ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তারা খাদ্যের জোগান চায় এবং দাম আয়ত্তে দেখতে চায়। তাদের আরেকটি দাবি_ নিরাপত্তা। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের সমর্থনেই ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু এখন অনেকে সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এর কারণ জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, দুর্নীতি ও প্রশাসনের অদক্ষতা উইলিয়াম শেকসপিয়রের অমর সৃষ্টি হ্যামলেটের সংলাপ_ও সঁংঃ নব
পৎঁবষ ড়হষু ঃড় নব শরহফ. বাংলাদেশের মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বর্তমান সময়ে এটিই সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা। তাকে ভালো কিছু পাওয়ার জন্য মন্দকে পিষে ফেলার পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে কিছু লোক অসন্তুষ্ট হবে, কিন্তু পাশে পাবেন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষকে। কোথায় কোথায় সরকারের সমস্যা রয়েছে, কোথায় ভুল হচ্ছে_ সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা তিনি পেয়ে যাবেন সরকারের তিন বছর উপলক্ষে সমকাল, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের জনমত জরিপে। এগুলোর ফল সরকারের জন্য যথার্থই উৎসাহব্যঞ্জক। দেশ চালাতে হলে সরকারকে নানা বিষয়ে, বিশেষ করে জনমতের খোঁজখবর রাখতে হয় এবং এ বিষয়ে নির্মোহ যথেষ্ট হলে ফায়দা আসে। সরকারের তিন বছর উপলক্ষে যেসব জরিপ করা হয়েছে তাতে কিন্তু বলা যায়, জনগণ দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের অভিমত প্রকাশ করেছে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এখন কঠিন সময় চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, রাশিয়া সর্বত্রই মানুষের ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠছে দ্রব্যমূল্য। প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা যাচ্ছে না। রাশিয়ায় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় জনগণের ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি শক্তি বাড়িয়ে নিতে পারছে। ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়াকে কমিউনিস্ট শাসনামলের মতো বিশ্বের প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার সংকল্প নিয়ে চলছেন এবং এ জন্য জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিচ্ছেন। কিন্তু তারপরও তিনি জনসমর্থন হারাচ্ছেন। তিনি নিজের ক্ষমতা যেভাবে আরও বাড়িয়ে নিতে চাইছেন, সেটাও জনগণ পছন্দ করছে না। তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে আমরা দেখছি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান কমছে। এ দুটি বিষয় কিন্তু পরস্পর সম্পর্কিত। স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে ভালো পড়াশোনা হয় না, শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে মন দিয়ে কাজ করা যায় না। বাংলাদেশে কলেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান অসাধারণ কাজ করছে। এখন বিশুদ্ধ সুপেয় পানির বিষয়ে মানুষ সচেতন। নারী শিক্ষা প্রসারিত হচ্ছে। মাত্র দুই বছরে অষ্টম শ্রেণী পাস করেছে ২৭ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে অর্ধেক ছাত্রী। তারা ভবিষ্যতে অনেক সুফল দেবে।
এখন মনে হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি আরও কয়েক বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেতেন, বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যেতে পারত। তাকে হত্যা করার এক মাসেরও কম সময় আগে ১৭ জুলাই (১৯৭৫) আমাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, বন্যায় ফসলের বিপুল ক্ষতি হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সময়মতো খাদ্য সাহায্য পাওয়া গেলে দুর্ভিক্ষ ( ১৯৭৪) সৃষ্টি হয় না। আমাকে দেশের নেতা হিসেবে সাফল্যের জন্য যেমন মানুষ স্বীকৃতি দেয়, তেমনি ব্যর্থতার দায়ভারও নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়।
বঙ্গবন্ধু বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস উত্তোলনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ জন্য ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতার প্রয়োজন ছিল এবং সেটা তিনি উপলব্ধি করেন। ১৫ আগস্টের পর এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত যে, তিনি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলেন তাতে বাংলাদেশ এতদিনে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারত। আমাদের আমলাতন্ত্রের মধ্যে বড় গলদ রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তারা ভুল স্বীকার করেন না। বঙ্গবন্ধু এ সমস্যা থেকে রেহাই পেতে জেলা গভর্নরের পদ সৃষ্টি করেছিলেন। এ ব্যবস্থা কার্যকর হলে জেলায় জেলায় প্রশাসনিক কাজে দায়বদ্ধতা বাড়ত। কাজের সমন্বয় থাকত।
আবার আসি জনমত জরিপ প্রসঙ্গে। এটা মনে রাখতে হবে যে, সমাজের সব অংশ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তারা খাদ্যের জোগান চায় এবং দাম আয়ত্তে দেখতে চায়। তাদের আরেকটি দাবি_ নিরাপত্তা। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের সমর্থনেই ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু এখন অনেকে সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এর কারণ জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, দুর্নীতি ও প্রশাসনের অদক্ষতা। প্রশাসন যত অদক্ষ হয়, দুর্নীতি তত বাড়ে। দুর্নীতির ব্যাধি থেকে কোথাও মুক্তি নেই। বাংলাদেশেও নেই। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কথায় আছে, দুর্নীতি হচ্ছে প্রবৃদ্ধির জন্য লুব্রিকেন্টের মতো। এর ব্যবহার করলে গাড়ি ভালো চলে। কিন্তু গাড়িতে লুব্রিকেন্ট বেশি হলে তা চলবে না। এ কারণে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। কেউ যদি ১০ টাকা ঘুষ নেয়, তাহলে তাকে বাড়তি ১০ টাকার কাজ করে দিতে হবে। টাকা নিয়েও কাজ করবেন না, এটা হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এটাই হচ্ছে।
জরিপ থেকে শেখ হাসিনার জন্য ইতিবাচক বার্তা রয়েছে_ ৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ভোগ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে হরহামেশাই জনমত জরিপ চালানো হয়। সেখানে কোনো প্রেসিডেন্ট একটানা জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেন না। শেখ হাসিনার সুবিধার দিক হচ্ছে, তিনি মানুষের দুঃখকষ্ট অনুভব করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারেন, 'যাওয়ার সময় হলে চলে যাব। ক্ষমতার পরোয়া আমি করি না। জনগণ না চাইলে থাকব না।' তবে তাকে সতর্ক থাকতে হবে যেন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়েন। তাঁবেদার-তোষামোদকারীরা সর্বদা নেতাদের আশপাশে থাকে। তারা সর্বদা বলতে চায়, সব ঠিক আছে। সত্য গোপন রাখতে নানাভাবে তৎপরতা চলে তাদের। শেখ হাসিনা একটি ভালো কাজ করেছেন_ কয়েকজন নারীকে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়েছেন। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে এ নিয়ে অনেক সমালোচনা হবে, এটা স্বাভাবিক। দেশে এখন হাজার হাজার নারী জনপ্রতিনিধি রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনে। নারী শিক্ষার প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া কোনো দেশ অগ্রসর হতে পারে না। আফ্রিকায় উপজাতি নেতারা শক্তিশালী এবং সেখানে পুরুষের আধিপত্য প্রশ্নাতীত। সেখানের লাইবেরিয়াতেও এখন নারী প্রেসিডেন্ট। আরও অনেক দেশে এখন নারী শীর্ষ ক্ষমতায়। জনগণের সমস্যার বিষয়ে এসব নেত্রী সাধারণভাবে বেশি সংবেদনশীলতা দেখান।
এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নারীর ক্ষমতায়ন মানেই হচ্ছে দেশের ভবিষ্যতের ক্ষমতায়ন। ভবিষ্যতের ক্ষমতায়ন না হলে বর্তমানের ক্ষমতায়ন হয় না। দুই বছরে যে ১৩-১৪ লাখ ছাত্রী অষ্টম শ্রেণী পাস করেছে তাদের মধ্যে যদি ৫ শতাংশও সৃজনশীল ও উদ্যমী হয়ে উঠতে পারে, এর অর্থ হচ্ছে প্রায় ৭০ হাজার চমৎকার কর্মী আমরা পেয়ে যাব। তারাই এগিয়ে নেবে বাকি ৯৫ শতাংশকে। শিক্ষার প্রসার হতে থাকলে বেকারও থাকবে না। তারা নিজেদের জন্য যেমন কাজ খুঁজে নেবে, তেমনি অন্যদেরও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
জরিপে দেখা যাচ্ছে, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর জনগণ ভরসা রাখতে পারছে না। তিনি একজন সামরিক নেতার স্ত্রী। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনে তার স্বামী জিয়াউর রহমান সহযোগিতা করেছেন। আর তিনি জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগাতে দিয়েছেন। তাকে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক পাল্লায় মাপা চলে না। শেখ হাসিনা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। আর খালেদা সেনা পরিবারের উত্তরাধিকার বহন করছেন। শেখ হাসিনার পরিবারকে যারা হত্যা করেছে তারা সেনাবাহিনীতে ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তিনি সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছেন। তিনি সেনাবাহিনীকে ভয় পান না। দেশের জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা করছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। খালেদা জিয়া জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঐক্য করে আরও একটি ইঙ্গিত দিচ্ছেন_ পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি তার রয়েছে অনুকূল মনোভাব। তিনি কখনও পাকিস্তানকে বলেন না_ একাত্তরের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। জামায়াতে ইসলামীও বলে না।
কিন্তু শেখ হাসিনাকে বুঝতে হবে যে দেশ ঠিকভাবে না চললে জনপ্রিয়তায় ধস নামবে এবং নেতিবাচক ভোটে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন। এ কারণেই তাকে যেখানে যেখানে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়, তাতে দ্বিধা করলে চলবে না। কোন নেতা বা কর্মী তার জন্য বা দলের জন্য কী করেছেন, কোন সচিব বা অতিরিক্ত ও যুগ্ম সচিব কখনও হয়তো বিশেষ কিছু অবদান রেখেছেন_ এসব বিবেচনায় নিয়ে তাদের ভুল কাজ মেনে নেওয়া যায় না। এতে দেশের ক্ষতি হয়। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রাউসেফ দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও ছেড়ে কথা বলেননি। তাদের বিদায় করে দিয়েছেন। শীর্ষ আমলাদেরও ছাঁটাই করেছেন। এটা ভাবেননি যে 'আমার জন্য এত করেছে, থাক না আরও কিছুদিন'। তিনি কঠোর হয়েছেন কিছু লোকের বিরুদ্ধে এবং এর স্পষ্ট উদ্দেশ্য_ অনেক অনেক লোকের জন্য সহৃদয় হতে চেয়েছেন। তিনি জানেন, জনগণের জন্য ভালো কিছু করতে হলে এমনকি নিজের এক সময়ের অতিপ্রিয় ব্যক্তিটিকেও বিসর্জন দিলে তা দূষণীয় নয়।
শেখ হাসিনা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হবেন, এটাই চাইব। এ প্রত্যাশা আমার নয়, বাংলাদেশের জনগণের।

জিল্লুর রহমান খান : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস

No comments

Powered by Blogger.