চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চে খালেদা জিয়া-তত্ত্বাবধায়কের ব্যবস্থা এ সরকারকেই করতে হবে by টিপু সুলতান ও তানভীর সোহেল

বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জানে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের ভরাডুবি হবে। সে জন্য দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। চারদলীয় জোটের রোডমার্চ কর্মসূচিতে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় ফেনীতে জনসভায় খালেদা জিয়া এ কথা বলেন।


এর আগে বেলা তিনটায় কুমিল্লার চান্দিনায় পথসভায় খালেদা জিয়া বলেন, নিজেদের সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচন করলে মস্ত বড় ভুল করবে। এ নির্বাচনে কোনো দল অংশ নেবে না। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নিয়ে সরকার ভাঁওতাবাজি করছে। কমিশন গঠন আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। আমাদের প্রধান দাবি হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা।’
ফেনীর জনসভায় বিএনপির নেত্রী বলেন, তাঁর দল ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। তিনি তরুণদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘প্রবীণদের অভিজ্ঞতা নবীনদের দরকার। নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে আমরা আস্তে আস্তে শিখিয়ে-পড়িয়ে ক্ষমতা তোমাদের হাতে তুলে দেব।’
খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেছিল। সে সময় তারা জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। আপনারা ক্ষমা করেছিলেন। এবার তারা যেসব অপকর্ম করেছে, আগামী ৪১ বছরেও আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’
এর আগে গত ১১ অক্টোবর বিএনপির প্রথম রোডমার্চে সিলেটে জনসভায় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তরুণ নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। দলের প্রবীণ নেতারা উপদেষ্টা হিসেবে তরুণ নেতৃত্বকে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন।
সিলেটের ওই বক্তৃতায় দলে নানা রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তিন মাসের মাথায় শেষ রোডমার্চের দিনে খালেদা জিয়া প্রথম রোডমার্চের ওই বক্তৃতা থেকে সরে এলেন। তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে গত বছরের অক্টোবরে সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নভেম্বরে খুলনা অভিমুখে রোডমার্চ করে চারদলীয় জোট।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয়। ঢাকার নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হওয়া এই রোডমার্চে চার হাজার গাড়ি অংশ নিয়েছে বলে দলটির নেতারা দাবি করেছেন। এ ছাড়া পথে আরও দুই হাজার গাড়ি যুক্ত হয়েছে বলে রোডমার্চ ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা দাবি করেন।
সাদা রঙের একটি গাড়িতে চড়ে খালেদা জিয়া রোডমার্চে নেতৃত্ব দেন। বহরে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও চারদলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতারাও অংশ নেন। ছিলেন বিএনপির সমমনা দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারাও।
যাত্রাপথে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে সড়কের দুই পাশে ও সড়কদ্বীপে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতিকৃতি বসানোর পাশাপাশি অসংখ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে।
ঢাকা থেকে যাত্রাপথে সায়েদাবাদ, ডেমরা, শনির আখড়া, কাঁচপুর সেতু, সোনারগাঁ মোড়, মদনপুর, মেঘনা ব্রিজের দুই পাড়, ভবেরচর, দাউদকান্দি সেতুর দুই পাড়, গৌরীপুর ও ইলিয়টগঞ্জ, চান্দিনা, পদুয়ার বাজার, চৌদ্দগ্রাম, ফেনী, মিরসরাইসহ বিভিন্ন স্থানে মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার নেতা-কর্মী ঢাকঢোল বাজিয়ে, প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকে অভিনন্দন জানান। খালেদা জিয়া হাত নেড়ে তাঁদের অভিনন্দনের জবাব দেন।
রোডমার্চের পথসভার মঞ্চে বসা নিয়ে বেলা দেড়টায় কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। আর ফেনীতে মঞ্চের সামনে বসা নিয়ে ছাত্রদল-যুবদলের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের তিন দফা সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়।
রোডমার্চের গাড়িবহর গতকাল রাতে চট্টগ্রামে পৌঁছায়। আজ সোমবার বিকেলে শহরের চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে জনসভার মধ্য দিয়ে শেষ হবে কর্মসূচি। ফেনীর জনসভায় খালেদা জিয়া বলেছেন, চট্টগ্রামের জনসভা থেকে পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
গতকাল সন্ধ্যা সাতটা ২ মিনিটে খালেদা জিয়া ফেনী পাইলট স্কুলমাঠের জনসভায় বক্তৃতা শুরু করেন। ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় তিনি বর্তমান সরকারের নানা ব্যর্থতা তুলে ধরেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়লে তাদের সরকারের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে।
খালেদা জিয়া প্রশ্ন করেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কেন শেয়ারবাজারে ধস নামে? কারণ, আওয়ামী লীগের লোকেরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের টাকা লুটপাট করে; এবং সেই টাকা বিদেশে পাচার করে দেয়। তিনি বলেন, ‘শেয়ারবাজারের দুর্নীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী তদন্ত করেছেন। কিন্তু রিপোর্ট প্রকাশ করার সাহস তাঁর হয়নি। আমার মনে হয়, শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতে এক নম্বরেরও যোগসাজশ থাকতে পারে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তদন্তে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁরা এত প্রভাবশালী যে তাঁদের নাম প্রকাশ করার সাহস তাঁর নেই।’
খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারকে ‘দুর্বল সরকার’ আখ্যায়িত করে বলেন, সীমান্তে মানুষ হত্যা হয়, তারা প্রতিবাদ করতে পারে না। বিজিবির এখনো সাহস আছে প্রতিবাদ করার, পাল্টা গুলি ছোড়ার; কিন্তু সরকারের নির্দেশ পায় না তারা। তিনি বলেন, ‘আপনারা কি চান, দেশ ভারতের হুকুমে চলুক? পররাষ্ট্রনীতি, সেনাবাহিনী ও বিজিবি ভারতের কথায় চলুক? যদি তা না চান, তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারকে বিদায় করতে হবে।’
তরুণদের উদ্দেশে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘সরকার পতনের আন্দোলনে আমি তোমাদের একা রাজপথে ছেড়ে দেব না। আমিও তোমাদের পাশে থাকব।’
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, এ সরকার ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে পরিকল্পিতভাবে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে। আজ পর্যন্ত সেই হত্যার বিচার হয়নি। ওই হত্যার উদ্দেশ্য বিডিআরকে দুর্বল ও ভেঙে দেওয়া। নাম পরিবর্তন করে এই বাহিনীকে রক্ষীবাহিনীর মতো নিজেদের লোক দিয়ে পরিচালনা করা।
খালেদা জিয়া গুপ্তহত্যা বন্ধেরও দাবি জানান।
গতকালের রোডমার্চে শুধু খালেদা জিয়ার নিজ জেলা ফেনীতে জনসভা হয়। এর আগে চান্দিনায় দুটি ও পদুয়ার বাজারে একটি পথসভা হয়।
বেলা তিনটায় জনসভা শুরু হলেও সকাল থেকে ফেনী শহরের পাইলট হাইস্কুল মাঠে জনসভাস্থলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা আসতে শুরু করেন। বেলা দুইটার মধ্যে মাঠ ভরাট হয়ে আশপাশের কলেজ রোড, জেল রোড, পোস্ট অফিস রোড, মিজান রোড, ট্রাংক রোড, এস এস কে রোড পর্যন্ত সমাবেশ ছড়িয়ে পড়ে।
জনসভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান, স্থানীয় সাংসদ মো. মোশাররফ হোসেন, জয়নাল আবদিনসহ (ভিপি জয়নাল) বৃহত্তর নোয়াখালীর দলীয় সাংসদ ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেন।
জোটের শরিকদের মধ্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুজিবুর রহমান, এলডিপির অলি আহমদ, খেলাফত মজলিসের আমির মো. ইসহাক, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম প্রমুখ বক্তব্য দেন। জনসভা পরিচালনা করেন সাংসদ রেহানা আক্তার (রানু)।
রেদোয়ানের ক্ষমা প্রার্থনা: চান্দিনার পথসভায় সভাপতির বক্তৃতায় এলডিপির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রেদোয়ান আহমেদ বিএনপির চেয়ারপারসনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে বেয়াদবি করেছি। দল ছেড়েছি। আমি সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। মাফ চাইছি। এখন থেকে আমি বাকি দিনগুলো আপনার পায়ে ধরে পার করব।’

No comments

Powered by Blogger.