খাদ্য আমদানি হ্রাস-স্বস্তিদায়ক চিত্রেও উদ্বেগ বাজারে

দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ায় চাল ও গমের আমদানি কমতে শুরু করেছে_ এমন খবর মিলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য সূত্র থেকে। জুলাই ও আগস্ট মাসে চাল ও গম আমদানির জন্য ৫৭৭ কোটি টাকার এলসি বা ঋণপত্র খোলা হয়েছে। গত বছর এই দুই মাসে এর পরিমাণ ছিল পাঁচগুণেরও বেশি_ ৩ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। সামনে রয়েছে আমন মৌসুম এবং এখন পর্যন্ত পূর্বাভাস_ ধানের ফলন ভালো হবে। প্রত্যাশামতো আমন ধান উৎপাদন হলে বাজারে খাদ্যশস্যের


জোগান যেমন বাড়বে, তেমনি আমদানির চাপ কম থাকবে। বৈদেশিক লেনদেনের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর খাদ্য পরিস্থিতির সার্বিক বিচারেও বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা '২০১১ সালে বিশ্বে খাদ্য অনিরাপত্তা চিত্র' তুলে ধরে বলেছে, খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্য বজায় থাকবে এবং সম্ভবত বাড়বে। বিশেষভাবে ঝুঁকিতে পড়বে খাদ্যশস্যের আমদানিকারক দেশগুলো। এমন শঙ্কাজনক বিশ্ব পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশের খাদ্যশস্য আমদানির ওপর চাপ কমাতে পারা নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। এর পেছনে কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের শ্রম-ঘামের অবদান রয়েছে। সরকার এবং বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও প্রশংসা পাবে। তবে খাদ্যশস্যে আমদানিনির্ভরতা কমে যাওয়ার পরও দেশের বাজারে খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্য বজায় থাকা উদ্বেগজনক। গত সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ এবং এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য চড়া হলেও বাংলাদেশ যেহেতু নিজের খাদ্য চাহিদার প্রায় সবটা নিজেই পূরণ করতে পারে সে কারণে অভ্যন্তরীণ বাজার এভাবে অস্থির হয়ে ওঠার কথা নয়। কৃষকদের যথাযথ মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার কারণেই বাজারে ধান-চালের অস্বাভাবিক মূল্য ঘটলে তার অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা থাকে। কিন্তু এমনটি ঘটেনি, বরং বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট-দৌরাত্ম্যের কারণেই বিশ্ববাজারের মতোই বাংলাদেশের খাদ্যের বাজারও চড়া। এর ফলে হতদরিদ্র ও নিম্নবিত্ত ছাড়াও নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী সমস্যায় পড়ছে। তাদের আয়েরও উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাচ্ছে ক্রমবর্ধমান খাদ্যদ্রব্যের ব্যয় মেটাতে। সরকারের জন্যও এ পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক নয়। একদিকে চড়া মূল্যে খাদ্য কিনতে বাধ্য হওয়ায় জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ, অন্যদিকে দরিদ্র জনগণের ওপর চাপ কমাতে মাসের পর মাস 'ওপেন মার্কেট সেল' চালু রাখতে হচ্ছে, যার বিপুল ভর্তুকির বোঝা চাপ বাড়াচ্ছে রাজস্ব বাজেটে। সামনের আমন মৌসুমে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে সরকার সক্রিয় হবে, এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করাই যায়। কিন্তু তা পূরণ হবে এমন সম্ভাবনা কম। কারণ, ব্যবসায়ীরা বাজার নিয়ন্ত্রণে সংগঠিত এবং সরকার তাদের কঠোর মনোভাব গ্রহণে আদৌ উৎসাহী বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় আমজনতার অসহায়ত্বই কেবল বাড়ছে। দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ছে, আমদানি কমছে এবং এ জন্য কৃতিত্বও দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাজারে লেগে আছে আগুন এবং তার তেজ কেবলই বাড়ছে। সার্বিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি ম্যাক্রো-অর্থনীতির জন্য স্বস্তির, অথচ নিত্যদিনের ক্রেতাদের জন্য তা নিতান্তই অস্বস্তির_ অর্থনীতির তাত্তি্বকদের জন্যও তা নিঃসন্দেহে মস্ত ধাঁধা।
 

No comments

Powered by Blogger.