সমস্যার তালিকা : স্বখাত সলিলে ডুবে মরি by ওয়াহিদ নবি

বি রাইনার মারিয়া রিলকে একজন বয়ঃকনিষ্ঠ কবিকে উপদেশ দিয়েছিলেন এই বলে, 'যদি তোমার মনে কোনো প্রশ্ন জাগে যার উত্তর তুমি জানো না, তবে উত্তর পাবার জন্য তাড়াহুড়া করো না। প্রশ্নটা সম্পর্কে ভালোভাবে চিন্তা করো, উত্তরটা পেয়ে যাবে।' আমার নিজের জন্মভূমির বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। নববর্ষে তাই রিলকের কথাটা মনে হলো। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান আমরা পেতে চাই শিগগির, কিন্তু সেটা বোধ হয় বাস্তবসম্মত নয়।


আসলে আমাদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে আমাদের ভাবার প্রয়োজন আছে। এ জন্য আমরা আমাদের সমস্যাগুলোর কিছু কিছু উল্লেখ করছি। আমরা এই সমস্যাগুলোর জন্য কাউকে দায়ী করছি না। কারো কাছে সমাধানও দাবি করছি না।
খাদ্যে ভেজাল একটা সমস্যা। মাছে ফরমালিন, মুড়িতে ইউরিয়া ইত্যাদির কথা আমরা শুনেছি। এও শুনেছি যে লিচুকে লাল দেখানোর জন্য গাছেই রং স্প্রে করা হয়। মেশানো জিনিসগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর_এটা জেনেও এই জিনিসগুলো মেশানো হয়। নৈতিক চরিত্রের কতটা অবনতি হলে এসব করা সম্ভব, তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
নারী নির্যাতনের কথা আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখি। এ সম্পর্কে যৌতুক, ফতোয়া, দোররা ইত্যাদির কথা আসে। আমাদের বীরপুরুষরা শ্বশুরের পয়সায় অবস্থাপন্ন হতে চায়। ধর্মীয় নেতৃত্বের দাবিদাররা শুধু নারীদের নৈতিকতার কথা ভাবে। কোনো সরকারি অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। আমলাদের উপার্জন ও তাদের জীবনযাত্রায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কিন্তু তবু আমলারা সমাজে সম্মানিত।
প্রতিদিন রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর শোনা যায়। রাস্তার অবস্থার কথা আমরা জানি। কিন্তু সে জন্য চালকদের জলদি যাওয়ার ইচ্ছা কমেনি। যানজট আরো খারাপ হয় বেআইনি ও বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য।
রেলগাড়ির অবস্থা বর্ণনার অতীত। বগিগুলোর কোনো দেখাশোনা নেই। সময়ানুবর্তিতার কোনো বালাই নেই। বুঝলাম, না হয় সময় রক্ষার ব্যাপারে আমাদের সুখ্যাতি নেই।
দ্রব্যমূল্য এতটা না হলে ভালো হতো। সিন্ডিকেটের কথা শুনি। কারা এসব রহস্যজনক ব্যক্তি, তা শুনিনি। যদিও জানি যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অনেক কারণ থাকতে পারে।
তদবির ছাড়া দেশে কোনো কাজ হয় না। উপযুক্ততার দাম হয়তো বা কিছু রয়েছে, কিন্তু সঙ্গে তদবির যুক্ত না হলে বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।
আমাদের রাজনীতির সামগ্রিক অবস্থা কী? রাজনীতি মনে হয় 'যুবরাজ' সৃষ্টির অনুকূল। অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে চাটুকারদের জয়জয়কার। অর্থের জোর রাজনীতিতে এখন বেশ অনুকূল। সামরিক ও বেসামরিক অবসরপ্রাপ্তদের জন্য রাজনৈতিক কর্মীদের নেতৃত্ব লাভ দুষ্কর। সংসদে নির্বাচিত হয়ে সংসদে না যাওয়া। হরতালের নামে ভাঙচুর এমনকি নরহত্যা। নিজে ভালো কাজ করলে জনগণ খুশি হয়। আস্থা বাড়ে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করার এটি সর্বোত্তম পন্থা। সেটা না করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরাসরি জব্দ করতে গিয়ে উত্তেজনা বাড়ানো এখনো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। দলের কাউন্সিল সভার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
একমাত্র সেলাইয়ের কল (যেগুলোকে গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি বলা হয়) ছাড়া আমাদের আর কোনো শিল্প-কারখানা নেই বললেই চলে। অথচ একসময় নারায়ণগঞ্জ প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার বলে পরিচিত ছিল। আমাদের বড় বড় পাটকল ছিল। আমরা এগিয়ে না গিয়ে পিছিয়ে পড়েছি। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে শিল্পজাত পরিবেশে গণতন্ত্র বিকাশ লাভ করে। আমাদের গণতন্ত্রের কতকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত উপসর্গের জন্য দায়ী সামন্তবাদী পরিবেশ।
ছিনতাই ও রাহাজানি একটা বড় সমস্যা। এখন গুপ্তহত্যা আর অপহরণের কথা শোনা যাচ্ছে। সরকারি বাহিনীর কেউ কেউ এর জন্য দায়ী_এমন কথা অনেকে বলছে। সরকার অস্বীকার করেছে। কোনো সুষ্ঠু তদন্ত এখন পর্যন্ত হয়নি। আগে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেছি। এখনো শোনা বন্ধ হয়নি। অপরাধজনিত কাণ্ড কমেনি। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলে যে পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখা হয়। একে অন্যের দোষ দিয়ে এসব ঘটনার কাহিনী কুয়াশাচ্ছন্ন করে রাখা হচ্ছে।
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার কমেনি। এর সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলোও তাই কমেনি।
ব্যাঙের ছাতার মতো 'বিউটি পার্লার' গড়ে উঠেছে। এসবের ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে কেউ কিছু চিন্তা করে না।
আমরা নিজেদের সম্পর্কে যা-ই ভাবি না কেন, বাইরের পৃথিবীতে বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত। পরিণতিতে অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত। অথচ সব ব্যাপারেই 'বিশ্বমানের' কথাটা বলতে আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। আমাদের দেশে সংঘটিত খুনখারাবির বিচার এত দিন বাংলাদেশ মানেই হয়েছে। এ নিয়ে কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নাকি 'বিশ্বমানের' হতে হবে। যদিও অপরাধগুলো হয়েছিল বাংলাদেশ মানের।
ছাত্রদের নেতৃস্থানীয় অনেকেই টেন্ডার নিয়ে ব্যস্ত। ছাত্রনেতারা অনেকে মধ্যবয়সী। তারা ভালোই আছে। ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।
বিবিসির বাংলা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের সেনাবাহিনী ব্যবসা-বাণিজ্যে ভালোই করছে। কী আর বলা যাবে! তাদের কিছু একটা তো করতে হবে।
বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক এলেঙ্ িটকোভিল বলেছিলেন, 'কোনো দেশে বিচারব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা উঠে গেলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।' আমাদের তা-ই হয়েছে।
পাদ্রি সাহেবরা প্রথম আমাদের দেশে আসে তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল আর আমাদের হাতে ছিল জমি। কিছুদিন পরে দেখি তাদের হাতে জমি আর আমাদের হাতে বাইবেল।' লেখাটি পড়ে হেসেছি, কিন্তু নিজেদের ইতিহাসের কথা ভাবিনি।
একটা কম্পিউটার সম্বল করে কেউ কেউ লাখ লাখ টাকা ছাপিয়ে ফেলছে। আমাদের টাকা কেমন যে, যে কেউ তা ছেপে ফেলতে পারে। এমনটা হলে মুদ্রাস্ফীতি তো হবেই।
বিদ্যুৎ সরকার আগের চেয়ে বেশি করে সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু গ্যাস নাকি প্রয়োজনমতো পাওয়া যাচ্ছে না। মিটার নেই বলে একটা ম্যাচের কাঠি বাঁচানোর জন্য গ্যাস ২৪ ঘণ্টা জ্বালিয়ে রেখেছি। আমরা অন্যকে দুর্নীতিবাজ বলে থাকি।
ভালো জিনিস আমরা দেখেছি। এ থেকে আমরা যেন শিক্ষা লাভ করি। পার্থিব চিন্তাধারার কারণে মধ্যবর্তী পরিবারে এখন সন্তানের সংখ্যা দুইয়ের বেশি নয়। রেফ্রিজারেটরের জন্য খাবার নষ্ট হয় না। আগে বিশ্বাস করা হতো, কোনো কোনো ফসল সব জায়গায় হয় না। এখন পঞ্চগড়ে চা উৎপাদন হচ্ছে, সমস্যা আরো আছে নিশ্চয়ই।
সমস্যা আমাদের আরো আছে। কে দায়ী জানি না। কাউকে দোষারোপ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। সমস্যার সমাধান করতে হলে সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। শুধু এটুকু জানি যে কোনো না কোনোভাবে আমরা সবাই দায়ী। তাই শ্যামাসংগীতের ভাষায় আমরা 'স্বখাত সলিলে ডুবে মরি'।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী চিকিৎসক

No comments

Powered by Blogger.