পাকিস্তান-জারদারি সরকারের দিন ফুরিয়ে এসেছে by কুলদীপ নায়ার

সামরিক বাহিনী যখন শুধু তাত্ত্বিকভাবেই সরকারের অধীন, তখন পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নিচ্ছে—এই অভিযোগের যুক্তি আমার মাথায় আসছে না। সামরিক বাহিনী যেকোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে থেকেই কাজ করে এটাই তার প্রমাণ। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দেশটির সুপ্রিম কোর্টের কাছে দেওয়া এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছে যে সামরিক বাহিনীর ওপর তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। সবাই জানে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত
বেশির ভাগ সময়ই দেশটি শাসন করেছে সামরিক বাহিনী। জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি ২০০৭ সালে সেনাপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে সচেতনভাবেই সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন, বেসামরিক প্রশাসন থেকে সামরিক কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাঁর আগ্রহ প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির দিকে; এ দুটি বিষয়ের ওপর তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন। তিনি যে আলোচিত চিঠিটির (‘মেমোগেট’) বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছেন, তা অতিসংগত। আইএসআইয়ের জনসংযোগ শাখা থেকে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘তিনি (কায়ানি) সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ সম্পর্কে সব ধরনের জল্পনা-কল্পনা খারিজ করে দিয়েছেন এবং বলেছেন, এগুলো প্রচার করা হচ্ছে বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে, দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলো থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে।’
বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেন হাক্কানি একজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে এই মর্মে একটি চিঠি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন যে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছে—তা প্রতিহত করতে আমেরিকা যেন সাহায্য করে। যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, বিষয়টি এখন পড়েছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের কাঁধে। কারণ সেখানে পিটিশন পড়েছে, সুপ্রিম কোর্টকে এখন ঘটনার আদ্যোপান্ত বের করতে হবে। প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী ইতিমধ্যে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, সামরিক বাহিনী বা ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি—কেউ-ই তাঁকে সত্য উদ্ঘাটন থেকে নিরস্ত করতে পারবে না।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি বলে চলেছেন, তাঁর সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র চলছে। সামরিক বাহিনী প্রবলভাবে অস্বীকার করলে তিনি বলেন, ওসামা বিন লাদেনের ওপর অভিযানকে কেন্দ্র করে পিপিপি সরকার যখন বিব্রত হয়েছিল, তখন তারা সামরিক বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল, তাদের কর্তৃত্বের সীমাকে যেন সম্মান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সামরিক অভ্যুত্থানের ভয় ও সামরিক বাহিনীর তা অস্বীকার থেকে আমার যা মনে হচ্ছে তা হলো এই, জাতীয় পরিষদে পিপিপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমে গেছে এবং গিলানি চাচ্ছেন শাসক দলের অবস্থার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দিতে সামরিক-বেসামরিক ‘দ্বন্দ্ব-সংঘাত’-এর দিকে।
এই দৃশ্যপটে আমেরিকা এসেছে বিনা প্রয়োজনে। দেশটি পাকিস্তানকে নিয়মিতভাবে যে অর্থ সাহায্য দেয়, তা থেকে ৩৬০ মিলিয়ন ডলারের একটা বরাদ্দ বাতিল করেছে। ন্যাটো-মার্কিন বাহিনীর হাতে ২৪ পাকিস্তানি সেনার হত্যাকাণ্ডের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। আমেরিকা তাদের ভুল স্বীকার করেছে কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করেনি। এখানে চীন কিছু সুযোগ দেখতে পেয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে তারা কূটনৈতিক দূত পাঠিয়েছে। এটা একটা দুঃখের বিষয় যে এ রকম মুহূর্তেও ইসলামাবাদ নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা ভাবছে না। দুই দেশের দুই গণতান্ত্রিক সরকার যৌথভাবে এমন একটা বার্তা সবার উদ্দেশ্যে পাঠাতে পারে যে সার্বভৌমত্ব রয়েছে জনগণের হাতে, জনগণই দেশ পরিচালনার জন্য তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। কিন্তু হতাশ হলাম জেনে যে, পাকিস্তানের সরকার সে দেশে ভারতবিরোধী মিছিলের অনুমতি দিয়েছে। ওই মিছিলের সামনে ছিলেন আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান হামিদ গুল, যিনি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছেন। আর ছিলেন হাফিজ সাঈদ, যিনি মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনাকারী। নয়াদিল্লির প্রতি তাঁদের ঘৃণার বিষয়টি বোধগম্য, কিন্তু সেই ঘৃণার প্রতি ইসলামাবাদের সায় বোধগম্য নয়। পাকিস্তান ভারতের সবচেয়ে পছন্দের দেশগুলোর (মোস্ট ফেভারড নেশন) সারিতে নাম লেখাক—সে দেশের ইসলামি গোষ্ঠীগুলো এর বিরুদ্ধে থাকবে এটা বোঝা যায়। তারা মনে করে, যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু, সে দেশটি হচ্ছে কাফেরদের দেশ। কিন্তু ইসলামাবাদ কেন এ ধরনের গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না? সন্ত্রাসবাদীদের ব্যাপারে পাকিস্তানের নীতিটা যে কী, তাও আমি বুঝতে পারি না। এক দিকে তারা নয়াদিল্লিকে এই আশ্বাস দেয় যে, মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক লোকের বিচার করবে, কিন্তু অন্যদিকে যারা ওই হামলার জন্য দায়ী, তাদের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করে।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম যখন বলেন, মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ইসলামাবাদ ওই হামলার ব্যাপারে যে তথ্যপ্রমাণ চেয়েছে নয়াদিল্লি তা যথেষ্টই দিয়েছে, তখন তাঁর কথাকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। আমার বিশ্বাস ছিল যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভারতবিরোধী অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। এমনকি যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কট্টর ভারতবিরোধী, তারাও নয়াদিল্লির সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির পক্ষে ছিল। কিন্তু ভারতবিরোধী ওই মিছিল দেখে আর নানা কথাবার্তা শুনে আমাকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে যে ইসলামাবাদ-প্রশাসন সত্যিই ভারতের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি চায় কি না। পাকিস্তান হয় দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছে, অথবা যারা সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের পাঠাচ্ছে, তাদের দমন করতে অক্ষম। একমাত্র আশার আলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরিফ। তিনি দাবি করেছেন, পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। তবে তাঁর উচ্চারিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। যে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তাতে তিনি জনগণের ভোট আকর্ষণ করেছিলেন ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলে। তিনি যখন আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবেন, তখন ইসলামাবাদ হয়তো অন্য রকম একটি নীতি গ্রহণ করবে। সে ঘটনা অচিরেই ঘটতে পারে। কারণ প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির সরকারের দিন শেষ হয়ে এসেছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.