সন্তোষ গুপ্ত : কালের প্রতিবিম্ব by প্রিয়তোষ গুপ্ত

'মাটির অনেক নিচে চলে গেছে? কিংবা দূর আকাশের পারে/তুমি আজ? কোন কথা ভাবছ আঁধারে?/ওই যে ওখানে পায়রা একা ডাকে জামিরের বনে/মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি_ তুমি ছাড়া সময়ের এ উদ্ভাবনে/আমার এমন কাছে_ আশ্বিনের এত বড়ো অকূল আকাশে/আর কাকে পাব এই সহজ গভীর অনায়াসে_' [তুমি : জীবনানন্দ দাশ] কিছু কিছু স্মৃতি আছে যা মানুষকে সারাজীবন আনন্দ দেয়, উদ্বেলিত করে, মানুষকে সামনে এগোতে সহায়তা করে। সেই সোনালি


স্মৃতিগুলোকে তাই আমরা বারবার স্মরণ করি। আমার বাবা সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে ও আমাদের ভাইবোনদের সেই রকম অসংখ্য স্মৃতি আছে, যা আমাদের প্রতিনিয়ত আনন্দ দেয়, অনাগত ভবিষৎ সম্পর্কে ভাবতে শেখায়। কিছু কিছু স্মৃতি আমাদের গর্ব করার মতো অনুভূতির জন্ম দেয়। স্মৃতি মানেই তো পিতার হাত ধরে চিনে নেওয়া আপন স্বদেশ।
সন্তোষ গুপ্তের পড়াশোনার ব্যাপ্তি এতই বিশাল ছিল যে, কখনও কখনও আমরা খুবই অবাক হতাম। মানুষ কীভাবে এত বিষয়ের ওপর জ্ঞান রাখতে পারে? বিজ্ঞানের প্রতি বাবার ছিল প্রবল আগ্রহ। রাজনীতি ছাড়াও নাটক, চিত্রকলা, শিল্পকলা, দর্শন, কবিতা বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অসংখ্য রচনা অগ্রন্থিত রয়েছে। শিল্প-সাহিত্যের সব অঙ্গনে তাঁর জ্ঞানের অবাধ বিচরণই তাঁকে এই অঙ্গনের মাস্টার (শিক্ষক) করে তুলেছেন।
প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন বাবা। ঘুম ছিল সর্বসাকল্যে চার ঘণ্টা। ভোর ৪টার দিকে উঠে চুলা ধরিয়ে নিজে কফি বানিয়ে খেতেন। সঙ্গে দুটি বিস্কুট। আমাদের বাড়িতে খুব ভোরে পত্রিকা দিয়ে যেত হকার। বাবা ৬টার মধ্যে সব পত্রিকা পড়ে ফেলতেন। তারপর লিখতে বসতেন। ৯টার দিকে অফিসে চলে যেতেন। আমরা প্রায়ই বলতাম, 'বাবা এত সকালে অফিসে যাও কেন? সংবাদ-এ তো কেউ এত সকালে আসে না।' বাবা বলতেন, 'সকালে গেলে সুবিধা আছে। নিজের মতো করে কাজগুলো শেষ করা যায়। বেলা হলেই লোকজনের আড্ডা আর হট্টগোল শুরু হয়। কাজ করা যায় না।' কাজ পাগল মানুষ ছিলেন বাবা। কাজ ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতেন না।
শৈশব থেকে জীবন-সংগ্রামী এক মানুষ কীভাবে আমৃত্যু সেই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে তাঁর দৃষ্টান্ত সন্তোষ গুপ্ত নিজেই, যাঁর সামনে অজস্র সুযোগ ছিল অর্থ সম্পদের মালিক হওয়ার, আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করার; কিন্তু তাঁর প্রোলেতারিয়েত জীবনযাপন তাঁকে একজন খাঁটি মানুষ হিসেবে পরিচিত করেছে, যিনি তাঁর অসাধারণ সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকবেন বহুকাল।
সন্তোষ গুপ্ত শুধু এই সমাজের একজন সংবাদকর্মীই ছিলেন না, বরং নিজের কর্ম আর চেতনার সম্মিলন দিয়ে হয়ে উঠেছেলেন সংবাদের সমাজকর্মী। জীবন চেতনার কোনো অংশ যদি ব্যক্তিমানুষের গণ্ডি ছাড়িয়ে স্পর্শ করতে পারে যুগ, কাল কিংবা সমকালীন সময়ের ঐতিহাসিক সত্যকে, তখন ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারে সমাজের প্রতিবিম্ব। মাস্টারমশাই সন্তোষ গুপ্ত তাই সেই কালেরই প্রতিবিম্ব।

No comments

Powered by Blogger.