বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা-প্রতিক্রিয়া by আবুল কাসেম হায়দার

নিয়ম-অনাচার বন্ধ করার জন্য সরকার আগে বলেছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন হলে সব দূর হয়ে যাবে। আইন তো হলো প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। পত্রিকায় প্রকাশিত অনিয়ম, দুর্নীতি-অনাচার তো বন্ধের কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ সরকারকে নিতে দেখলাম না। তা হলে বোঝা যাচ্ছে নতুন আইনের প্রয়োজন ছিল না, ছিল আইন প্রয়োগের। নতুন আইন তো হয়েছে তাতে কি উন্নতি হয়েছে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা বাংলাদেশের


পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখা হয়। তাতে দেশের উপকার হচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারেরও প্রয়োজনীয় করণীয় ঠিক করতে সুবিধা হচ্ছে। তবে অনেক সময় অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিষয়ে সবকিছু অবগত না হয়ে অনেক কথা বলে ফেলেন, তাতে অনেক প্রতিষ্ঠানের বেশ ক্ষতি হয়। গত ১ জানুয়ারি সমকালে তারেক শামসুর রেহমান বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা শীর্ষক একটি প্রবন্ধ আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। তিনি ওই প্রবন্ধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি (এপিইউ) সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মনে হয় অসতর্কতাবশত লিখেছেন, 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ অব বাংলাদেশ (এপিইউ) কর্মকাণ্ড নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এপিইউবি শুধু এর বিরোধিতাই করছে না, বরং একাধিকবার তথাকথিত গোলটেবিল বৈঠকের ব্যবস্থা করে এর নেতিকবাচক (?) দিকগুলো তুলে ধরছেন।' তিনি কেন এভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের প্রছন্দ করছেন না, জানি না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য হিসেবেও তিনি কিছু দিন কাজ করেছেন। হয়তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি নিয়ে বেশি দেখাশোনার সুযোগ পাননি। তাই প্রতিষ্ঠাতাদের সম্পর্কে 'তথাকথিত' শব্দ ব্যবহার করে তাচ্ছিল্য করলেন। তার জন্য এক বিজ্ঞ ব্যক্তি থেকে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার আশা করিনি।
এটি সবার জানা কথা, ১৯৯২ সাল থেকে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকার অনুমোদন দিয়েছে। আইনগত কারণে ৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অবশিষ্ট ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী চলছে।
অনেক দিন পর দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়ন ও সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানের উদ্দেশ্যে কয়েক বছর আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি গঠিত হয়। সমিতি গঠনের পর থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নানা সমস্যা ও মানগত উন্নয়নের জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ প্রণয়নের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। অনেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের স্বার্থরক্ষা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ অব বাংলাদেশ (এপিইউবি) ইতিমধ্যে বেসরকারি ও সরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য অপপৎবফরঃধঃরড়হ পড়ঁহপরষ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে ওই অপপৎবফরঃধঃরড়হ পড়ঁহপরষ গঠনের জন্য একটি শক্তিশালী কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অচিরেই এর কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
প্রবন্ধে লেখক তারেক শামসুর রেহমান আরও অভিযোগ করেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নানা দোষ ও অন্যায়কে একপাশে সরিয়ে রেখে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা খোলার বিরোধিতা করছে। দেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যদি শাখা খুলতে না পারে, তবে কীভাবে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে শাখা খুলতে পারবে? একই আইনের ধারা লঙ্ঘন করে কোনোভাবেই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে শাখা খোলার অনুমতি দেওয়া যাবে না। অন্যদিকে সমিতি কখনও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গভাবে স্থাপনের কোনো বিরোধিতা করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। লেখক মালয়েশিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলেছেন। মালয়েশিয়ায় অস্ট্রেলিয়ার এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চলছে। তা তিন হাজার বা ২৪ হাজার বর্গফুটের ভাড়া করা কোনো বাড়িতে এসব বিশ্ববিদ্যালয় চলছে না। আমরাও বাংলাদেশে সে রকম পূর্ণ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় চাই। তিন হাজার বা ২৫ হাজার বর্গফুটের মধ্যে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা সার্টিফিকেট বাণিজ্য করার সুযোগ দিতে কোনোভাবেই সম্মত নয়। লেখকের সঙ্গে আমিও একমত, বাংলাদেশে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একই মানের নয়। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট বাণিজ্য করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আমরাও এসব খবর পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। এ অনিয়ম-অনাচার বন্ধ করার জন্য সরকার আগে বলেছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন হলে সব দূর হয়ে যাবে। আইন তো হলো প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। পত্রিকায় প্রকাশিত অনিয়ম, দুর্নীতি-অনাচার তো বন্ধের কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ সরকারকে নিতে দেখলাম না। তা হলে বোঝা যাচ্ছে নতুন আইনের প্রয়োজন ছিল না, ছিল আইন প্রয়োগের। নতুন আইন তো হয়েছে তাতে কি উন্নতি হয়েছে?
তারেক শামসুর রেহমান তার প্রবন্ধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অনিয়মের বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় কী নিয়মে, কেন হওয়া উচিত তার বিশেষ কোনো কারণ বর্ণনা করেননি। বিদেশ বিশ্ববিদ্যালয় বিধিমালায় কোচিং সেন্টার ও বিভিন্ন বিষয় কোর্সকে বিধিমালার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি কোনোভাবেই মানা যায় না। কোচিং সেন্টার বন্ধ করার জন্য জাতীয় শিক্ষানীতিতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। সে অবস্থায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিধিমালার মধ্যে কোচিং সেন্টার অনুমোদনের বিধি নিয়ে আসা আরেকটি নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে। তাই ধারা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার কথা আমরা বলেছি। বর্তমান আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫ কোটি টাকা এফডিআর রাখার বিধান আছে। কিন্তু এ ধারায় বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৬ ধারা পুরো মানা হবে, আবার অন্যত্র তাদের ক্ষেত্রে ৫ কোটি টাকা এফডিআর রাখার কথা বলা হয়নি। আমাদের বক্তব্য, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষেত্রে দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আরও বেশি শর্ত থাকা উচিত। অথচ দেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যেসব কঠিন শর্ত রয়েছে, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সেসব শর্ত শিথিল করা হয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ শতাংশ গরিব-মেধাবী ছাত্রছাত্রীর বৃত্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষেত্রে কিছুই বলা হয়নি। একই সমতলে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিযোগিতার সুযোগ দিতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ ট্রাস্টি, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে যেসব বিধান রাখা হয়েছে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ওইসব নিয়মের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের কমিটি রয়েছে। কমিটি যদি স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে তবে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ লাভ করবে। কমিটি যদি স্বচ্ছ না হয় তবে কিছুতেই যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাবে না। এ ক্ষেত্রে যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষকরা নিজের বিবেক হারিয়ে ফেলেন, তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যদি শিক্ষক ও প্রতিনিধিরা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়োগের মাধ্যমে নিজের স্বকীয়তা, চরিত্র হারিয়ে ফেলেন, তখন জাতির জন্য বড়ই দুর্ভাগ্য। এ অবস্থার পরিবর্তন শুধু আইন দিয়ে হবে না। আমাদের চরিত্রে, নীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসতে হবে।
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা শিরোনামে লেখায় লেখক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান প্রবন্ধ শেষে ৬টি পরামর্শ রেখেছেন। তার ভালো ভালো পরামর্শ। প্রথম পরামর্শে তিনি লিখেছেন_ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানের উন্নয়নের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের কথা বলেছেন। তাও শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, কিন্তু কেন? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি গুণ-মানের উন্নয়নের প্রয়োজন নেই। অ্যাক্রিডিটেশন শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য হবে কেন? সরকারি ও বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব কেন তিনি দিলেন না? অথচ ইউজিসি সরকারি ও বেসরকারি উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ড্রাফট করার সময় শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ড্রাফট করে বিলি করে মতামত চেয়েছেন। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, পাবলিক ও প্রাইভেট উভয়ের জন্য একই অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল হতে পারে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা খোলার অনুমতি প্রদানের জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বিধিমালা প্রণয়ন উদ্যোগ ভালো। তবে তাতে কোচিং সেন্টারকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে কোচিং সেন্টারকে বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। আমরাও তা চাই। তখন আবার আইন করে তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হলো_ শিক্ষানীতির নিয়ম লঙ্ঘন করা। তা কোনোভাবেই করা উচিত হবে না।
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশে পূর্ণাঙ্গরূপে স্থাপিত হোক, তা আমরা সবাই চাই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা শাখা নেই। ভারত সরকার অনুমতি দেয়নি। লেখক ভারতের কথা উল্লেখ করেছেন। তা ঠিক হয়নি। মালয়েশিয়া অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হয়েছে। তাও মালয়েশিয়া পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশাল ভূমি নিয়ে অত্যাধুনিক ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত। আমরাও তা চাই। ওই মানের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় হলে আমরাও স্বাগত জানাব। তিন হাজার বর্গফুটের মধ্যে ভাড়া বাড়িতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা খোলার বিধিমালা কোনোভাবেই জাতি গ্রহণ করবে না।

আবুল কাসেম হায়দার : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহ-সভাপতি এফবিসিসিআই ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.