জনমত জরিপ-‘কোনো সরকার পবিত্র হয় না’ by মোহীত উল আলম

সাবেক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের রসবোধ সম্পর্কে আমি কিয়ৎ পরিমাণ পরিচিত ছিলাম। কিন্তু গত শনিবার (৭ জানুয়ারি ২০১২) বাংলা একাডেমীর একটি অনুষ্ঠানে তাঁর একটি ‘পান’ (দ্বিত্ব অর্থক) বা ছুটকো মন্তব্য আমাকে একেবারে মজার শেষ সীমায় নিয়ে যায়। অনুষ্ঠানটি ছিল বাংলা একাডেমী কর্তৃক দ্বিখণ্ডে প্রকাশিত প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে চা-নাশতা খাওয়ার সময় হাবিবুর রহমান আর গ্রন্থটির সম্পাদকদ্বয়ের


অন্যতম পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপক পবিত্র সরকার (আরেকজন সম্পাদক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম) পাশাপাশি বসেছেন। তখনই ছুটে এল মন্তব্যটি। মুহান্মদ হাবিবুর রহমান পবিত্র সরকারকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আমাদের একটা পবিত্র সরকার দরকার’। সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র সরকার বললেন, ‘কোনো সরকারই পবিত্র হয় না।’
একটা পবিত্র সরকার! এই খোঁজে যেন পরিচালিত হলো ডেইলি স্টার আর প্রথম আলোর ৬ জানুয়ারি সংখ্যা, যেটি ছিল বর্তমান মহাজোট সরকারের শাসনের তিন বছর পূর্তি অথবা চতুর্থ বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে জরিপ দিবস। প্রথমআলো বাংলাদেশের সব বিভাগ থেকে পাঁচ হাজার লোকের আর স্টার দুই হাজার ৫০০ লোকের মধ্যে জরিপ চালিয়ে সমীক্ষা দিয়েছে যে আওয়ামী লীগের সরকার জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে পড়েছে এবং মানুষ বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকায় সন্তুষ্ট না হলেও তারা জনপ্রিয়তায় এগিয়ে গেছে। এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়ার চেয়ে অনেকখানি সমর্থন হারিয়েছেন।
যেকোনো রাষ্ট্রীয় এবং সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় পরিসংখ্যান সবচেয়ে জরুরি উৎস। সমাজজীবন এবং রাষ্ট্র যত আধুনিক হবে, তত পরিসংখ্যানভিত্তিক কর্মসূচির দিকে দেশ এগিয়ে যাবে। এদিক থেকে আলো-স্টারের বার্ষিক জরিপ সরকার এবং বিরোধী দল উভয়কে সতর্কভাবে অনুসরণ করতে হবে।
বিরোধী দলকে সংসদে আনতে আন্তরিকতার প্রশ্নে জরিপের ফলাফল হলো ৫৪ শতাংশ মনে করছেন, সরকার আন্তরিক নয়। আমার প্রশ্ন হলো, রোববার টিভির (এটিএন নিউজ) এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মীর্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, তাঁরা মাত্র ৩০ জন সদস্য, সংসদে গিয়ে তো তাঁদের কোনো কাজ নেই। সব ইস্যুতে ভোটে হেরে যাবেন। এটা কেমন ব্যাখ্যা হলো? তাঁরা ৩০ জন যান বা ১৩০ জন যান সে জন্য তো সরকারি দল দায়ী নয়। তাঁরা সংসদের বেতন-ভাতা সব নেবেন অথচ থাকবেন গরহাজির, সেখানে সরকারের আন্তরিকতার অভাবের প্রশ্ন কীভাবে ওঠে? তাঁরা সংসদ নামক একটা খেলায় নেমেছেন, কিন্তু খেলার নিয়ম মেনে খেলবেন না, এটা কেমনতরো ভূমিকা! যে ৫৪ শতাংশ সরকারকে আন্তরিক নয় মনে করেন, তাঁরা পাঁচ হাজার জনের মধ্যে শতকরা হিসেবে এসেছে। এখন ১৬ কোটি লোকের মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার জনের মধ্যে জরিপ চালানো হলো পৃথিবী দিয়ে সূর্য মাপার মতো। জরিপকারীদের অবশ্য এ ছাড়া গত্যন্তরও নেই।
এভাবে রাজনীতি, অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্য, জীবনযাত্রার মান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম—সব ক্ষেত্রে মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে ‘না’ ভোট বেশি পড়েছে এ জরিপ দুটোয়। আওয়ামী লীগের মধ্যকার অন্তর্কোন্দলের বিষয়টি বাদ দিয়ে যদি দেখি, তা হলে ২০১০-এর চট্টগ্রামের মেয়র মহিউদ্দিনের পতন, ২০১১-তে নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমানের পতন এবং কুমিল্লায় ২০১২-তে আফজল খানের পতন ইঙ্গিত করছে যে ২০১৪ সালের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পতন হতে পারে। আলো-স্টারের পরিসংখ্যান জরিপের ফলাফল সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস—তাই বাস্তবে বিভিন্ন নির্বাচনের ফলাফলেও প্রতিফলিত হয়েছে। সে জন্য এখন থেকে আওয়ামী লীগের শিরদাঁড়া কেঁপে ওঠা উচিত। কিন্তু কাঁপছে কই, বরঞ্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক তাক লাগানো কথাই বলেছেন, নির্বাচনের ফলাফলে তিনি পরাজিত হতে ভীত নন। প্রধানমন্ত্রীর দায়টা এখানে বোঝা যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা বিলুপ্তির পর বিএনপি এটার পুনঃপ্রতিষ্ঠার নামে আন্দোলনে নেমে হালে পানি পেয়েছে। সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব হলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালিত নির্বাচনের মতোই নিখুঁত এবং নিরপেক্ষ হতে পারে তার প্রমাণ রাখা। সে প্রমাণ রাখতে গিয়ে তাঁর দলের পরাজয়ও তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রীর এ অভিব্যক্তিটি শক্ত নীতির ওপর অবস্থান করছে এবং এ মনোভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গি তিনি যদি পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারেন, তা হলে নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, তাঁর অবস্থান ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি আগামী সরকারের জন্য দিকনির্দেশনামূলক বাতাবরণ তৈরি করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হওয়ার পর এ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত প্রায় প্রতিটি নির্বাচন প্রশংসনীয়ভাবে নিরপেক্ষ, সন্ত্রাস-বিরহিত এবং সর্বোচ্চ অংশগ্রহণের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। যে আইভিএম পদ্ধতি গ্রহণ করার ব্যাপারে বিরোধী দলের মধ্যে অনিশ্চয়তা আছে, সে আইভিএমের সহযোগে পরিচ্ছন্ন ফলাফল পাঁচ ঘণ্টায় বের হয়ে এল কুমিল্লায়।
প্রধানমন্ত্রীর মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আমার ভয়টা একই জায়গায়। সেটি হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতা চলে যায় অনির্বাচিত এবং অগণতান্ত্রিক একটি গোষ্ঠীর হাতে, যার সমর্থনে আসতে হয় প্রতিরক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তখন সেখানে আশঙ্কাজনকভাবে অনিয়মতান্ত্রিকতা বেড়ে যাওয়ার একটি দরজা সব সময় খোলা থাকে। যেটা প্রায়ই হয়েই গেছিল ২০০৭ সালে আবির্ভূত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তিন মাসের জের জাতিকে টানতে হলো পুরো দুটি বছর। দুই প্রধান নেত্রীরই জেল খাটা হলো, হলো আরও এন্তার ধরপাকড়। কিন্তু ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেষ পর্যন্ত পূর্ণ সামরিক সরকারে পরিণত হতে পারেনি, তার কারণগুলো হলো জাতিসংঘের নিয়োজিত শান্তিবাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাদের অংশগ্রহণ, যেটা থাকত না যদি দেশ সামরিক শাসনের কবলে পড়ে যেত; দুই, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সম্ভাব্য অভাব; এবং তিন, একটি ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে বলছি, তখনকার সামরিক বাহিনীর প্রধান মইন ইউ আহমেদের সৌজন্যচারিতা। তিনি চট্টগ্রামের জিওসি থাকাকালে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চেনার আমার সুযোগ হয়। তিনি খুব সজ্জন, সদালাপী এবং নিরহংকারী লোক ছিলেন। খুবই উঁচু মূল্যবোধ নিয়ে চলতেন। তাঁর এ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কারণেই তিনি ক্ষমতা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন বলে আমার ধারণা। কিন্তু সব সামরিক অফিসার যে তাঁর মতো হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। কাজেই, এখনকার শক্তিশালী এবং সফল নির্বাচন কমিশন যদি মেয়াদ ফুরোনোর পর সব দলের আলোচনার মাধ্যমে অনুরূপ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দ্বারা অভিষিক্ত হয় এবং সরকারের আচরণ যদি স্থানীয় নির্বাচনের সময়কালীন প্রদর্শিত একই রকম সহনশীল হয় তা হলে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে জাতি ঠকবে না বলে মনে হয়। আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, দলীয় সরকারের শাসনের সময় কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্য কাজ করে, যা গণতান্ত্রিক শক্তিকে গতিশীল করে। কিন্তু অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক সরকারের বেলায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য কাজ করে না। ভয়টা সেখানে। রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার প্রাথমিক পর্ব হিসেবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু হয়েছে। এটি কার্যকরভাবে সফল হোক সেটা জাতির কাম্য।
আরেকটি কথা: গত পাঁচ বছরের পত্রিকা খুলে দেখুন। দেখবেন, আমরা সব সময় প্রার্থনা করেছি, কবে এ দেশ সুষ্ঠু, সন্ত্রাসবিহীন নির্বাচন দেখতে পাবে, আর কবে আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষায় শৃঙ্খলা আসবে, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমবে, শিশু বাপের পেছনে গরুর হাল না ধরে বই হাতে স্কুলে ছুটবে। শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ একান্তভাবে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে সে স্বপ্নটিই পূরণ করে যাচ্ছেন। একটি জাতির সকল রকমের উন্নতির মূল আরাধ্য সূচকটি হচ্ছে শিক্ষা। এ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক থেকে ওপরের পর্যায়ে বেশ একটি আন্দোলন-আলোড়ন যাচ্ছে এবং এ ইতিবাচক পরিবর্তনটি এ সরকারের আমলেই ঘটে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলি, বিএনপির গত মেয়াদের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নকল নিরোধে প্রশংসাজনক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
একটি সরকার সব ব্যাপারে সফল হতে পারে না, কিন্তু কিছু মৌলিক বিষয়ে সরকারের প্রভূত অর্জন ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক সূচক হয়ে দাঁড়াবে। দেশ ও সমাজ কোনো ঐন্দ্রজালিক প্রভায় বদলায় না, বদলায় চোখের সামনে ইতিবাচকতা আর নেতিবাচকতা মিলে মিলে, শিশু যেমন টলটলায়মান অবস্থা থেকে একপর্যায়ে দাঁড়াতে শেখে, ঠিক সেভাবে।
জরিপের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও আমাদের সজাগ থাকতে হবে। সুপরিচিত রসজ্ঞ মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, পরিসংখ্যানের চেয়ে মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না। এ হেঁয়ালিপূর্ণ কথাটি ক্রিকেট দিয়ে বোঝানো যাবে। টেন্ডুলকার পরিসংখ্যানে সবচেয়ে এগিয়ে। কিন্তু দেশত্রাতা হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্ষেত্রে ব্রায়ান লারার বা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ইনজামাম-উল-হকের যে অবদান, তার ধার-কাছেও নেই টেন্ডুলকার ভারতের ক্ষেত্রে। তেমনি যেকোনো জরিপে আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকার প্রথমেই আউট হয়ে যাবে এ রকম একটি সরকার, কারণ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন, রাস্তাঘাটে ঘা, জীবন নিরাপত্তাবিহীন, পুঁজির বাজার সংকটে, বিদেশি মুদ্রার অবস্থা খারাপ, শিক্ষাঙ্গনে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদি কারণে। কিন্তু এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতিতে মৌল কর্মগুলো এ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদের সময় সাধিত হয়েছে বলে ইতিহাস বলবে। জরিপের দার্শনিক উৎস হচ্ছে একটি পবিত্র সরকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে জাতিকে সাহায্য করা। কিন্তু এর প্রায়োগিক ক্ষমতা হচ্ছে সমালোচনাভিত্তিক। পরিসংখ্যান খোঁজা বাস্তব পরিস্থিতি বোঝার জন্য। কিন্তু এটা যে শেষ কথা নয়। মানুষের জীবন যেমন বিচিত্র, রাষ্ট্রীয় জীবনও তা-ই, সরকারি জীবন তো বটেই। আজকে যদি মহাজোটের সরকার সত্যি সত্যি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে ফেলতে পারে, তা হলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জরিপ যা-ই বলুক না কেন এ সরকারকে পুনর্নির্বাচিত হওয়া থেকে ফেরাতে পারবে না। কাজেই মহাজোটের সরকারের জন্য একটি বা দুটি কুঠারাঘাত দরকার।
অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম: সভাপতি, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.