শ্রদ্ধাঞ্জলি-ইতিহাসের উজ্জ্বল এক নাম

মার আব্বা ছিলেন স্পষ্টভাষী বীর মুক্তিযোদ্ধা। নাম বললে অনেকেই তাঁকে চিনবেন। মানিক চৌধুরী। পোশাকি নাম এ কে লতিফুর রহমান চৌধুরী। কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে হবিগঞ্জের আপামর মানুষ তাঁকে কমান্ড্যান্ট উপাধিটা দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব, অহংকার। আমার জন্য আরও গৌরবের।
এ প্রজন্মের অনেকের মতো আমারও মুক্তিযুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু মনে পড়ে আব্বার কাছ থেকে শোনা অনেক


গল্প-কাহিনি। যদিও তিনি ছিলেন কিছুটা প্রচারবিমুখ। আব্বাকে আমি বেশি দিন পাইনি। মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁকে হারিয়েছি। এত অল্প সময়ে আব্বাকে যতটুকু দেখেছি, তা আমার স্মৃতিতে জীবন্ত ও স্পষ্ট।
১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল আব্বার শেষ বিজয় দিবস। এর কিছুদিন আগে থেকে আব্বার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। কিডনির অবস্থা বেশ খারাপ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ডান হাতের হাড়ে ব্যথা। সব সময় আব্বার শরীরে জ্বর থাকত। তার পরও তাঁকে বিরত করা যায়নি বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া থেকে। সেদিন সকালে আব্বা আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে। আমার যখন থেকে বোঝার বয়স হয়েছে, তখন থেকেই আমাকে সঙ্গে করে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। সেবার আমি আব্বার হাত ধরে কাকডাকা ভোরে লম্বা বাঁশের মাথায় উড়িয়েছিলাম আমাদের প্রিয় লাল-সবুজের পতাকা। তারপর গেলাম কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে।
কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে আব্বা আমাকে নিয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করলেন। অনুষ্ঠানে আমি আব্বার সঙ্গে এক পাশে বসে ছিলাম। কয়েকজনের অনুরোধে আব্বাও সেখানে কথা বললেন। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর শেষ বক্তব্য। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আব্বা আরও কিছু কথা বলেছিলেন। তখন আমি মর্মকথা বুঝতে না পারলেও এখন বুঝি, সে দিন আব্বা তাঁর মনের ইচ্ছা ও স্বপ্নের কথাগুলো বলেছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আব্বা বলছেন, ‘একদিন কম্পন হবে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যায়ন হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হবে। সে দিন বেশি দূরে নেই, যে দিন সরকার বুঝবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার প্রয়োজন নেই। কিছুমাত্র কুলাঙ্গার, যারা দেশের সঙ্গে বেইমানি করেছে, সরকারকে অনুরোধ করছি তাদের তালিকা করুন। আগামী প্রজন্ম ধিক্কৃত হিসেবে যাতে তাদের নাম জানতে পারে।’
আমার আব্বা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কখনো রাজধানীকেন্দ্রিক রাজনীতি করেননি। সারাজীবন থেকেছেন প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে। দুবার (১৯৭০ ও ১৯৭৩) জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির চর্চা করেননি। সাদামাটা জীবনই তাঁর প্রিয়। আমাদের হবিগঞ্জ শহরের বাড়িটি (আব্বার পৈতৃক বাড়ি) ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতার পর অনেক দিন লেগেছিল নতুন বাড়ি করতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর আব্বাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সাড়ে তিন বছর পর মুক্ত হন। তারপর পুড়ে যাওয়া বাড়িতে টিনের ছাপরা ঘর করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই টিনের ছাপরা ঘরেই বসবাস করেছেন। শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের পর আব্বাকে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার। এসব কথা শুনে আব্বা ভীষণ রাগ করে নাকি বলতেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করেছি দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ চাইব কেন?’
মুক্তিযুদ্ধকালে হবিগঞ্জে আব্বার ভূমিকা ছিল অনন্য। ২৫ মার্চের পর তাঁর নির্বাচনী এলাকার চা-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে গঠন করেছিলেন বিরাট বাহিনী। নির্বাচিত এমএনএ হয়েও সরাসরি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সম্মুখ লড়াই করেন।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে ভোররাতে আব্বার কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি তারবার্তা আসে (সেই তারবার্তা আব্বা মুক্তিযুদ্ধকালে নিজের কাছে রেখেছিলেন। ফলে আগুনে পোড়া থেকে রক্ষা পায়। তারবার্তাটি এখনো সংরক্ষণ করা আছে)। সেই তারবার্তায় ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিলখানায় ইপিআর ও রাজারবাগে পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেছে। নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে। ইপিআর ও পুলিশ ঢাকার রাজপথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। জনগণ প্রাণপণে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সকল স্থানে সকল শ্রেণীর জনগণকে শত্রুবাহিনীকে যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করার জন্য আহ্বান জানানো যাচ্ছে। আল্লাহ আপনার মঙ্গলে সহায়তা করুন। জয় বাংলা। মুজিবুর।’
এ প্রসঙ্গে শেখ ফজলে এলাহী তাঁর মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ বইয়ে লিখেছেন: মানিক চৌধুরী শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রেরিত টেলিগ্রাম নিয়ে উপস্থিত হন মহকুমা হাকিমের অফিসের বটতলায়। সেখানে উপস্থিত হয়েছিল হাজার খানেক মানুষ। মানিক চৌধুরী একটি ট্রাকের ওপর উঠে ইংরেজিতে লেখা টেলিগ্রাম সবাইকে দেখিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণার বিবরণ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রেরিত এ তারবার্তা জনগণকে উদ্বেলিত করে তোলে। অনির্ধারিত ওই জনসভায় মানিক চৌধুরী এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে সবাইকে আহ্বান জানান প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। মানিক চৌধুরীর আহ্বানে সমবেত জনতা সমর্থন জানায় বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মাধ্যমে। মানিক চৌধুরীর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে হবিগঞ্জ মহকুমার সূচনা হয় প্রতিরোধ সংগ্রামের।
হবিগঞ্জ তথা সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায় কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী একটি কিংবদন্তি নাম। সমাজসেবা ও ত্যাগের মধ্যেই যে রাজনৈতিক ব্যক্তিজীবনের সফলতা, এ সত্য আব্বা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন তাঁর প্রতিটি কর্মে। সে জন্যই হয়তো তাঁর মৃত্যুর পর সবাইকে বলতে শুনেছি মানিক ভাইয়ের মতো এমন সৎ, পরোপকারী ও দেশপ্রেমিক মানুষ মেলা সত্যিই ভার।
আগামীকাল (১০ জানুয়ারি) আব্বার ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯১ সালেআব্বা আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। আব্বা তুমি যেখানেই থাকো, তোমাকে ভুলব না।
কেয়া চৌধুরী
kchowdhury71@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.