একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না by ড. মো. আবদুল হক তালুকদার

ক তথ্যে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায়, তার ৫৮ শতাংশ পথচারী, ২৯ শতাংশ যাত্রী এবং ১৩ শতাংশ চালক। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটটের মতে, জাতীয় মহাসড়কের ৪ শতাংশ এলাকায় ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। ৪ শতাংশ সড়কে দুর্ঘটনার কারণ হলো হাটবাজার, বাসস্টেশন ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সাত হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা জিডিপির ২ শতাংশ। দৈহিক ও মানসিক ব্যয় যোগ


করলে এর পরিমাণ অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ১০ বছরে এর পরিমাণ হবে দ্বিগুণ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মতে, ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে জাতীয় মহাসড়কে, ১২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ১৫ শতাংশ শাখা সড়কে (ফিডার রোডে)। এআরআই ২০০৯ সালে এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ১৫টি দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটি তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ১৫টি দেশের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় বেশি মৃত্যু হয় নেপালে এবং বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭০ হাজার। এতে মারা গেছে ১৫ হাজার নারী-পুরুষ। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ওই সময়ে মারা গেছে দুই লাখ মানুষ। বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ সেলের হিসাবে, ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪২ হাজার ৪৫৭টি। আর নিহত হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৫ জন এবং আহত হয়েছে ২৯ হাজার ৭৮৭ জন। তাদের মতে, দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ১২ হাজার এবং প্রতিবন্ধিত্বের শিকার হচ্ছে লক্ষাধিক মানুষ। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ৪১ হাজার ৭৯১টি (পুলিশের প্রতিবেদন অনুসারে) সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ২৭ হাজার ৫৯৫ জন নিহত এবং ২৫ হাজার ৪৩৮ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ৩৬ হাজার ১৯৯টি মামলায় মাত্র দুই হাজার ২৬৯ জনের শাস্তি হয়েছে। কারাগারে বন্দি আছে ২৫৭ জন। মামলাগুলোর মধ্যে ১৯ হাজার ১৮৬টি অভিযোগপত্র এবং ১৬ হাজার ২৬১টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যানে কিছুটা হেরফের থাকলেও বাস্তব অবস্থা খুবই ভয়াবহ।
বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সারা দেশে সাড়ে ১৫ লাখ যানবাহনের নিবন্ধন আছে। এর মধ্যে প্রায় এক লাখ যানবাহন চলাচল করে না। বাকি সাড়ে ১৪ লাখ যানবাহনের জন্য ১০ লাখ চালকের লাইসেন্স আছে। অর্থাৎ সাড়ে চার লাখ চালকের কোনো লাইসেন্স নেই। এসব চালকের ভুয়া লাইসেন্স রয়েছে বলে সহজেই অনুমেয়। গাড়ি চালানোর অন্তত দুই ডজন নিয়ম আছে, যেগুলো পড়ে শিখতে হয়। সুতরাং চালক হতে হলে লেখাপড়া জানা আবশ্যক। কেননা চালক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তাত্তি্বক ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে হয়। গাড়ি চালানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্তত ৩০টি আইন রয়েছে। এ আইনগুলো সম্পর্কে জানলে চালকরা আরো সতর্কতা অবলম্বন করবেন।
সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে তিনটি উপাদান জড়িত। প্রথমত, সড়ক পরিবেশ, যানবাহনের অবস্থা এবং চালকের বৈধতা। রাস্তার ডিজাইন এবং প্রকৌশলগত দিক বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এতে রোড শোল্ডার বা সাইড ওয়াক থাকা প্রয়োজন; যাতে পথচারীরা অনায়াসে চলাফেরা করতে পারে। কিন্তু আমাদের ওয়াকওয়েগুলো দোকানদার, নির্মাণসামগ্রী দ্বারা দখলকৃত বলে পথচারীরা রাস্তায় চলে আসে এবং দুর্ঘটনা ঘটে। প্রতিটি সড়কে হার্ড ও সফট শোল্ডার থাকা দরকার। হার্ড শোল্ডার গাড়িকে রাস্তার বাইরে যেতে প্রতিরোধ সৃষ্টি করবে এবং সফট শোল্ডার পথচারীদের প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া রোড মার্কিং, ট্রাফিক সংকেতও গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ বাঁক নেওয়া কিংবা বড় গাছের জন্য দেখতে না পাওয়া, বাঁকে ওভারটেক করার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে।
গাড়ির ফিটনেস একটি বড় সংকট। সব যানবাহনের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা মূল বডিতে পরিবর্তন করে হয় দৈর্ঘ্যে কিংবা পাশে বাড়িয়ে নিয়েছে কিংবা ওভারলোড করছে। ফলে গাড়ি ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে না। ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় দেড় লাখ অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল করছে মহাসড়কে। মালামাল ও যাত্রী বহনের কিছু নীতিমালা রয়েছে, যেমন ট্রাক কখনো মানুষ বহন করতে পারে না। হাইওয়েকে দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা ব্যাপক। কিন্তু তাদের রয়েছে জনবল ও যানবাহন সংকট। রয়েছে উন্নতমানের প্রশিক্ষণের অভাব, ঝুঁকি অনুসারে বেতন-ভাতার স্বল্পতা, রয়েছে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর অসাধুতা। ফলে অনিয়মগুলো দেখেও তাঁরা না দেখার ভান করেন। সড়কগুলোর ভগ্নদশা এবং যানজটের ফলে সময়ের অপচয় ঘটে। সময়ের অপচয় রোধকল্পে চালক তখন বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়। কিছু যাত্রী আছে, যারা চালককে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে তাড়িত করে, আস্তে চালালে টিপ্পনী কাটে; এমনকি গালাগাল করতেও দ্বিধা করে না। প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার বাণিজ্যিক গাড়ি রাস্তায় নামছে, অথচ সরকারি পর্যায়ে চালক তৈরি হচ্ছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাজার।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধ : থ্র্রি 'ই'র মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। এগুলো হলো_Engineering (প্রকৌশলগত দিক), Education (শিক্ষা) এবংEnforcement (কার্যকর প্রয়োগ)। প্রকৌশলগত বিষয়টির সঙ্গে রাস্তা, যানবাহন, চালক ও পথচারী জড়িত। অর্থাৎ রাস্তা হওয়া চাই মসৃণ ও প্রশস্ত, যানবাহন হবে ত্রুটিমুক্ত, চালক হবেন শিক্ষিত ও দক্ষ এবং পথচারী হবে সচেতন। শিক্ষা বলতে যানবাহন ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সবার যথাযথ জ্ঞান থাকা চাই। অবশেষে প্রয়োজন ট্রাফিক আইনকানুনের যথাযথ প্রয়োগ। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলেই রাস্তায় ফিটনেস ছাড়া গাড়ি চলছে, লাইসেন্স ছাড়া বা ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালানো হচ্ছে, চালকের দোষে দুর্ঘটনা ঘটলেও তিনি বা তাঁর মালিক থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিআরটিএর হিসাবে, ৫০ শতাংশ চালকের লাইসেন্স নেই, ৮০ হাজার গাড়ি চলছে ফিটনেস ছাড়া।
যানবাহন মালিকদের করণীয় : ১. যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় বের না করা; ২. বৈধ কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি রাস্তায় না চালানো; ৩. বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের বৈধতা যাচাইপূর্বক গাড়িচালককে নিয়োগ প্রদান।
চালকদের করণীয় : ১. সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালানো; ২. গতিসীমা লঙ্ঘন করে গাড়ি না চালানো; ৩. গাড়ি চালানোর সময় এয়ার ফোন বা মোবাইল ফোন ব্যবহার না করা; ৪. মাদক সেবন করে বা ঘুম ঘুম ভাব হলে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকা; ৫. ট্রাফিক আইন, সাইন ও পুলিশের নির্দেশ পুরোপুরি মেনে চলা; ৬. একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো; ৭. বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি না চালানো; ৮. গাড়িতে অতিরিক্ত যাত্রী বা মালামাল বহন না করা; ৯. ট্রাক তথা খোলা যানবাহনে যাত্রী বহন না করা; ১০. রাস্তার বাঁকে, সরু ব্রিজ এবং ডান পাশ দিয়ে গাড়ি অতিক্রম করার সময় ওভারটেক না করা; ১১. মোটরসাইকেলচালক ও আরোহীদের হেলমেট ব্যবহার করা; ১২. যাত্রী দ্বারা তাড়িত হয়ে গাড়ির গতিসীমা লঙ্ঘন না করা।
পথচারীদের করণীয় : ১. ফুটপাত দিয়ে চলাচল করা; ২. যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে রাস্তার ডান পাশ দিয়ে চলাচল করা; দৌড়ে রাস্তা পার না হওয়া; ৩. রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিং, ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার করা।
লেখক : সচিব, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.