সাংবাদিক দীনেশ 'হত্যা'-সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চাই দৃঢ় সংকল্প

বাসচাপা পড়ে নিহত হলেন আরো একজন সাংবাদিক। তাঁর নাম দীনেশ দাশ। গতকাল রবিবার রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় দীনেশ দাশকে চাপা দেয় বেপরোয়া গতির একটি বাস। এর কয়েক দিন আগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিআরটিসির একটি বাস কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার নিখিল ভদ্রকে চাপা দিয়েছিল। তিনি এখনো পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর একটি পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। এর আগে গত আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক


খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং টিভি চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান সম্পাদক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে তাঁদের বহনকারী মাইক্রোবাসটিকে চাপা দিয়েছিল চুয়াডাঙ্গা ডিলাঙ্ পরিবহনের একটি বাস। আমাদের সভ্য রাষ্ট্রে সড়ক নামের যে মরণফাঁদ তৈরি হয়েছে, তাতে তারেক, মিশুক, দীনেশ কিংবা নিখিল কেন, আমরা কেউই নিরাপদ নই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) মতে, প্রতিবছর গড়ে ১২ হাজার দুর্ঘটনা ঘটে। এই সংখ্যা কি কেবলই স্ফীত হতে থাকবে? কোনোভাবেই কি চেক দেওয়া যাবে না?
আমাদের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় মহাসড়কগুলোতে ২১৯টি স্বয়ংক্রিয় গতিনিয়ন্ত্রক বা র‌্যাম্পল স্ট্রিপ স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে ওজন স্কেল স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নেরও উদ্যোগ নিয়েছে। নিঃসন্দেহে এগুলো ভালো উদ্যোগ। এতে মহাসড়কগুলোতে যদি দুর্ঘটনা কিছুটা কমে, মানুষ উপকৃত হবে। কিন্তু ঢাকা মহানগরীর দুর্ঘটনা কি তাতে কমবে? গাড়িচালকদের স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা বেপরোয়া গাড়ি চালনা কি তাতে কমবে? এক বাস আরেক বাসকে সাইড না দিয়ে তেরছাভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালনা কি তাতে কমবে? বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া কি র‌্যাম্পল স্ট্রিপ কমাতে পারবে? ওজন স্কেল কি লাইসেন্সবিহীন কিংবা ভুয়া চালক-নেশাখোর চালক চিনতে পারবে? পারবে না। যতক্ষণ গাড়িচালকদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব দূর করা না যাবে, সড়কে আইন প্রতিষ্ঠা করা না যাবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না যাবে, ততক্ষণ র‌্যাম্পল স্ট্রিপ বা ওজন স্কেল খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। আর, সড়কে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য সবার আগে যা প্রয়োজন, তা হলো সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা, সুদৃঢ় সংকল্প।
পরিবহন মালিক, চালক ও শ্রমিকদের আচরণ দেখে মনে হয়, বাংলাদেশে একমাত্র তারাই স্বাধীন। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে যে বাসটি চাপা দিয়েছিল, সেই বাসটির চালককে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়, সে জন্য বাসশ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছিল। সেই বাসচালককে গ্রেপ্তারের দাবি জানানোর কারণে আরেক সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল, তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছিল। অন্যায় দাবি নিয়ে বাসশ্রমিকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসা খ্যাতনামা অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিকে জুতাপেটাও করেছিল বাসশ্রমিকরা। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীকেও তাদের পক্ষে কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। বিনা পরীক্ষায় এ ধরনের শ্রমিকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার জন্য চাপও সৃষ্টি করা হয়েছিল। কাজেই এই দুর্দান্ত বাসচালকরা দীনেশ-নিখিলদের চাপা দিতে কুণ্ঠিত হবে কেন? তারা তো জানেই, তাদের হাত অনেক লম্বা। বিভিন্ন সময় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে এক-তৃতীয়াংশের বেশি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই কিংবা তারা ভুয়া লাইসেন্সধারী। ট্রাফিক পুলিশও তা জানে। মাঝেমধ্যে ধরেও। আবার, উৎকোচ নিয়ে ছেড়েও দেয়। অনেকেই সম্ভবত ভুলে যাননি মিরসরাই ট্র্যাজেডির কথা। যে মিনি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে গেলে ৪৮ শিক্ষার্থী মারা গিয়েছিল, সেই ট্রাকটিও চালাচ্ছিল চালকের হেলপার। তারও কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। তদুপরি দুর্ঘটনার সময় সে মোবাইল ফোনে কথা বলছিল। একে তো আমাদের বিদ্যমান আইনের অনেক দুর্বলতা রয়েছে, আবার সেই আইনের প্রয়োগ আরো বেশি দুর্বল। চট্টগ্রামে ২০০৩ সালে ১১ জন কিশোর ক্রিকেটার মারা গিয়েছিল যে দ্রুতগামী হিউম্যান হলারের ধাক্কায়, সেই হলারচালকের মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। তদুপরি তাকে গ্রেপ্তারই করা যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.