আশা-নিরাশার দোলাচলে কোপেনহেগেন সম্মেলন by মাহফুজ উল্লাহ

প্রায় শুরু থেকেই আবহাওয়া নিয়ে মানুষের মাথাব্যথার শেষ নেই। দৈনন্দিন জীবনের রুটিনকে বদলে দিতে পারে বলেই আবহাওয়া নিয়ে এই উদ্বেগ। অথচ আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি আমানত জলবায়ু সম্পর্কে মানুষের ধারণাটা ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল না। কিন্তু গত কয়েক দশকে পৃথিবীজুড়ে আবহাওয়া ও জলবায়ু মানুষের উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু কি উদ্বেগ?
এ নিয়ে শঙ্কার শেষ নেই এবং এমনও মনে করা হচ্ছে, জলবায়ুতে যে পরিবর্তন ঘটছে তা মানুষের জীবনকে আরও সঙ্কটাপন্ন করে তুলতে পারে। এক সময় মনে করা হতো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রাকৃতিক কারণই দায়ী। কিন্তু হাল আমলে সে যুক্তি আর ধোপে টিকছে না। এখন প্রায় মোটামুটি সবাই একমত যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানুষই দায়ী। মানুষের এ দায় তৈরি হয়েছে তার জীবনযাপনের পদ্ধতির কারণে। অর্থাত্ মানুষের কারণেই বেড়েছে গ্রিন-হাউস গ্যাসের নির্গমন। আর তা বাড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রার বৃদ্ধি মানুষের মূল উদ্বেগের বিষয় এবং কী করে এই তাপমাত্রা কমানো যায় সে বিষয়ে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সভা-সেমিনার প্রভৃতি। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানে কী করা যেতে পারে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এ বছরের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হবে জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক সম্মেলন। অনেক দিন ধরেই অনেকে আশা করেছিলেন, এই সম্মেলনে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের ব্যাপারে একটা ঐকমত্য হবে — যেখানে ধনী দেশগুলোর দায়িত্ব হবে অনেক বেশি এবং বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব প্রায় থাকবে না বললেই চলে। আর মাত্র তেত্রিশ দিন পর অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলছে সম্মেলনের ভবিষ্যত্। সম্মেলন ঠিকই হবে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বস্ল লোক এ জলবায়ু জাম্বুরিতে যোগ দেবেন। কিন্তু ফলাফল কী হবে সে বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের ফেদ্ধমওয়ার্ক কনভেনশন অব ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসি) নির্বাহী পরিচালক ২৮ অক্টোবর ২০০৯ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘কোপেনহেগেনে একটি জলবায়ু চুক্তি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা, কিন্তু সে সম্ভাবনা প্রায় সুদূরপরাহত।’ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ নিয়ে পৃথিবীতে এখন তিনটি অবস্থান প্রায় সুস্পষ্ট। ধনী দেশগুলোর মাতবর হিসেবে এসব পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফিদ্ধকা ও রাশিয়া। আর বাকি দলে রয়েছে অন্য দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ অন্যতম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বিত্ত ও ক্ষমতার কারণে তারা এই বিপর্যয়কে বিপর্যয় মনে করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সময় জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকাকে বিবেচনায় আনতে রাজি ছিল না। এ কারণে ১৯৯৭ সালে যখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সারা পৃথিবী ঐক্যবদ্ধ হয়ে কিয়েটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হয়নি। সমস্যার মূল এক জায়গায় — আর তা হচ্ছে জীবনযাপনের সঙ্গে প্রকৃতির বিরোধ। মানুষের বেহিসেবি জীবনযাপনের কারণে শুধু জলবায়ুতে নয়, আরও অনেক কিছুতেই পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ তার আচরণ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছে জীববৈচিত্র্যকে যা পৃথিবীজুড়ে লাখ লাখ মানুষের খাবারের উত্স। মানুষের আচরণের কারণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। ইউএনএফসিসি’র নির্বাহী পরিচালক আরও বলেছেন, কোপেনহেগেন সম্মেলনে ১৯২টি দেশের প্রতিনিধিরা ‘যে দরকষাকষি করবেন তাকে শেষ জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি না হলে কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বই সদিচ্ছার পরিচয় দেয় না। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব তার জাতীয় স্বার্থকে বাদ দিয়ে সামনে এগোতে রাজি হয় না। এ বিষয়টি অতিসম্প্রতি স্পষ্ট হয়ে গেছে চীন ও ভারতের অবস্থানের কারণে। গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে যত না আগ্রহী তার চেয়ে বেশি আগ্রহী এর ক্ষতিকর দিকগুলো প্রশমনের জন্য। যার মধ্যে রয়েছে অভিযোজন ও প্রশমন পরিকল্পনা, যেখানে প্রযু্ক্তি একটা বিরাট ভূমিকা পালন করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি অনেক দেশের নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি বিরাট উদাহরণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সেখানে তার জন্য অভিযোজন হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। এই অভিযোজনের প্রক্রিয়াটি আবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম হতে বাধ্য। কোপেনহেগেন সম্মেলনে জাতিসংঘের একটা লক্ষ্য হচ্ছে, শিল্প বিপ্লবের পর পৃথিবীর তাপমাত্রা যে হারে বাড়তে শুরু করেছে তাতে তাকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (৩.৬ ফারেনহাইট) সীমিত রাখা। এর পরও এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মারাত্মক বৃষ্টি, খরা, বন্যা ও দাবদাহ অব্যাহত থাকবে। তার পরেও, কোপেনহেগেনের প্রস্তুতি নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে যেসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে উদ্বেগের সঙ্গে সমস্যা সমাধানের ঐকমত্যের খুব একটা সম্মিলন ঘটেনি। এ লেখা যখন প্রকাশিত হচ্ছে তার দু’দিনের মধ্যেই শুরু হচ্ছে বার্সেলোনা বৈঠক। কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগে এটি আন্তর্জাতিক প্রয়াসের শেষ বৈঠক। কিন্তু শেষ বৈঠকেও সমাধানের শেষ চেষ্টা খুঁজে পাওয়া যাবে না। গোল বেঁধেছে ১৯৯০ সালের পৃথিবীব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের যে পরিমাণ ছিল তা থেকে বর্তমান হার কমিয়ে আনা। উন্নত দেশগুলোর মিলিত সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, তারা ২০২০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ কমিয়ে দিতে রাজি। অন্যান্য ধনী দেশ রাজি হলে তারা এটাকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত কমাতে রাজি আছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রায় উল্টো। তারা ১৯৯০ নয়, ভিত্তি ধরতে চায় ২০০৫ সালকে। অর্থাত্ ১৯৯০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ১৫ বছরের গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ যে হারে বেড়েছে তাকে তারা অস্বীকার করেন। ক’দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে আইন পাস করেছে তাতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে তারা ২০০৫ সালের তুলনায় কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ১৭ শতাংশ কমাতে রাজি আছেন। শুভঙ্করের ফাঁকটা এখানেই। জাতিসংঘও বলছে, জলবায়ু সম্পর্কিত একটি নতুন চুক্তির পূর্বশর্ত হচ্ছে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য গরিব দেশগুলোকে সাহায্যের বিষয়টি। অনেক দেশ এ ব্যাপারে আলাদাভাবে সাহায্য করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেও প্রয়োজন একটি সামগ্রিক সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ দাবি করেছে, এ ক্ষতি মোকাবিলায় পৃথিবীর ধনী দেশগুলো যেন প্রতিবছর তাদের মোট জাতীয় আয়ের ১.৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়। কারণ তাদের কারণেই গরিব দেশগুলো দুর্গতির মধ্যে পড়েছে। এ দাবিটি অনেকাংশে উচ্চাকাগ্ধক্ষী। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ধনী দেশগুলো প্রতি বছর তাদের মোট জাতীয় আয়ের ০.৭ শতাংশ অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কোনো দেশই সে কথা রাখেনি। অর্জিত হয়নি লক্ষ্যমাত্রা। এ সিদ্ধান্তটিও গৃহীত হয়েছিল জাতিসংঘের উদ্যোগেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মনে করে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ২০২০ সালের মধ্যে বার্ষিক ৭,৪০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। এই টাকা কোত্থেকে আসবে? সে ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো জবাব নেই। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র কেন সমান হারে চাঁদা দিয়ে তহবিল গড়ে তুলবে? কারণ সমস্যার জন্য সবার দায়িত্ব এক নয়। তাই কোপেনহেগেনকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। কোপেনহেগেন সম্মেলনে যে সিদ্ধান্তটি সবচেয়ে জরুরি তা হচ্ছে, ২০২০ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ধনী দেশগুলো গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ কতটা কমাবে সেটা। আর এখানেই রাজনীতির প্রশ্নটি অর্থাত্ প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
লেখক : পরিবেশবিদ ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.