দরগাতলায় মন মজেছে...by শাকিল ফারুক

কার্তিক মাসের পূর্ণিমা রাত। কুয়াশা আর জোছনায় মাখামাখি চারপাশ। ইছামতীর বুকে এখন পানি কম। সেই পানিতেই আকাশ থেকে নেমে এসেছে ভরা চাঁদ। শীতল বাতাস কাঁপন তুলছে জলে, টলমল করছে কাঁসার থালার মতো চাঁদটাও। চাঁদের টলমলানো দেখতে দেখতে জোছনায় নদীর অদূরের মেঠোপথ ধরে হেঁটে চলেছি। সঙ্গে তিন বন্ধু_সজীব, সুমন আর তন্ময়। গন্তব্য দোসরপাড়া টেকেরহাট। উদ্দেশ্য লালন সাঁইয়ের গান শোনা।


টেকেরহাটের পদ্মহেম ধামে প্রতিবছর আয়োজিত হয় লালন শাহ বটতলা সাধুসঙ্গ। দেশ-বিদেশের লালন সাধক, ভক্ত-অনুসারীরা লালনজীবনী, সাধনাবিষয়ক বয়ান আর লালনগীতি পরিবেশনের মাধ্যমে উদ্যাপন করেন দুই দিনের এই আয়োজন। এ বছর অনুষ্ঠিত হলো পঞ্চম সাধুসঙ্গ।
১.১১.১১_তারিখটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের কত উচ্ছ্বাস। সেদিন রাতেই ছিল এবারের সাধুসঙ্গের উদ্বোধনী দিন। গত চার বছর এই সাধুসঙ্গে স্থানীয় লোকজনের চেয়ে ঢাকার মানুষেরই ভিড় দেখেছি বেশি। তারিখটা ১.১১.১১ হওয়ায় ঢাকা থেকে রওনা দেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, এবার হয়তো খুব বেশি মানুষ জমায়েত হবে না। কিন্তু পদ্মহেম ধামে পেঁৗছে তো চোখ কপালে। পদ্মহেম ধামে যেন ঢল নেমেছে মানুষের। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, যাঁরা আসবেন না বলেই মনে হয়েছিল, দেখা গেল তাঁরাই আগে হাজির হয়েছেন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানস্থলে পেঁৗছাতে ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়েছে রাত ১১টার ঘর। তারও আগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এখন গান চলছে পুরোদমে। এবার সাধুসঙ্গ ঘিরে রীতিমতো মেলা জমেছে। অনেক অস্থায়ী দোকানে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। স্থানীয় লোকজন তো আছেই, দেশের নানা অঞ্চল থেকেও এসেছেন লালনভক্তরা। মূল মঞ্চের সামনের শামিয়ানার নিচে জায়গা হয়নি বেশির ভাগ মানুষের। নিজ দায়িত্বে চাটাই জোগাড় করে তারা শামিয়ানার বাইরেই করে নিয়েছে বসার জায়গা। নদীর পাড়ে বসে গেলাম চাটাই বিছিয়ে। মজে গেলাম গানে। সামনে বটতলার নিচ থেকে ভেসে আসছে সাঁইজির সুরেলা বাণী। পেছনে নদীর জল ছুঁয়ে আসছে হিমেল বাতাস। মাথার ওপরে চাঁদ। সে এক অপার্থিব পরিবেশ!
আসর তখন তুঙ্গে। বন্ধুরা ডুবেছে সুরের মূর্ছনায়। আমি তখন খুঁজে পেলাম নতুন সঙ্গী-সাথিদের। তুহিন দা, সুমন, আবু হেনা বাজপেয়ি, দোদুল, ত্রিবেণী আর রুশোদের সঙ্গে জুটে গেলাম। ওদের সঙ্গে এবার সাধুসঙ্গে এসেছিল সুইডেনের আনা। গান শোনার ফাঁকে ফাঁকে কথা হলো সাধুসঙ্গে আসা আরো অনেকের সঙ্গে। টাঙ্গাইল থেকে আসা শিপন বললেন, 'কুষ্টিয়ার পর এটাই মনে হচ্ছে লালনের দ্বিতীয় বড় আসর। এখানকার পরিবেশও চমৎকার। আর ঢাকার কাছেই হওয়ায় অনেক লালনভক্তই সাঁইজির বাণী শুনতে আসতে পারবেন এখানে। প্রচারণা আরেকটু বাড়ানো উচিত।'
এখানে এসেছেন যাঁরা, সেই বাউল-সাধকদের পরিবেশনাও অসাধারণ। ভিন্ন মতও পাওয়া গেল। ঢাকা থেকে এসেছেন জহিরুল আলম। ধবধবে সাদা চুলে ভর্তি মাথা। চোয়ালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সাধুসঙ্গ কেমন হচ্ছে? প্রশ্ন শুনেই রীতিমতো খেঁকিয়ে উঠলেন, 'কুষ্টিয়ার আসরটা ধ্বংস করার পর এখন এই আসরটাও নষ্ট করা হচ্ছে। এখানে এসেছি সাঁইজির গান শুনতে। সাঁইজির গানের আসর। গত বছরগুলোতে শান্তিতে গান শোনা গেছে বটে। কিন্তু এবার তো মেলা জমেছে। গানের আসরে এসব কেন?' সেটাও একটা কথা বটে।
তখন কথায় কান দেওয়ার সুযোগ কই! মঞ্চে যে তখন ক্লোজ-আপ তারকা রিংকু। সমবেত জনতার সে কি উল্লাস! তার আগে শেষ হয়েছে ভারতের বিখ্যাত লালন সাধক দরবেশ সাধন ফকির, জাপানের ফকিরানী মাকি কাওজুমি, মদন দাস বৈরাগী, স্বপন অধিকারী, নারায়ণ অধিকারী, সম্রাট বাউলা, সুমন্ত বাউলসহ তাঁদের দলের পরিবেশনা। বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার দরবেশ নহির শাহ, দরবেশ মহরম শাহ, দরবেশ সামসুল শাহ ও দরবেশ বুড়ি ফকিরানীসহ ৩০ জন সাধুগুরু লালন জীবনী, সাধনাবিষয়ক বয়ান ও লালনগীতি পরিবেশন করেন।
সাঁইজির গান পরিবেশন করেন রাজ্জাক বাউল, শফি মণ্ডল, আরিফ বাউল, পাগলা বাবলু ও ক্ষুদে গানরাজ মুন্নাসহ অনেক বাউল শিল্পী। কথায়-গানে কখন পেরিয়েছে পূর্ণিমা রাত, টেরই পাওয়া যায়নি। দিনের আলো ফুটল যখন, গানের আসর থামল তখন। কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো গোষ্ঠ গানের আসর। আসর শেষে রওনা হলাম ঢাকার পথে। কানে তখনো সাঁইজির বাণী। আর পেছনে দ্বিতীয় দিনের আসরের অপেক্ষায় থাকা লালনভক্তরা।

No comments

Powered by Blogger.