মঠবাড়িয়া : আওয়ামী লীগ-বিভক্তি নিয়েই চলছে by দেবদাস মজুমদার,

০০৩ সালের পর মঠবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো কাউন্সিল অনুষ্ঠিত না হওয়া, সংসদ নির্বাচন পরবর্তী দলের সিনিয়র দুই নেতার দলীয় পদ স্থগিত, উপজেলা চেয়ারম্যানের ওপর দলের কতিপয় দলীয় নেতা-কর্মীর হামলা-মামলা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বিভক্তি নিয়েই চলছে এখানকার আওয়ামী লীগের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব কারণে দলের কর্মকাণ্ড ছিল অনেকটাই স্থবির।


এই আড়াই বছরে দলের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা দলীয় কোনো কর্মকাণ্ডে উপস্থিত ছিলেন না। ফলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়েই কাটছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি। জাতীয় দিবসগুলোর কিছু অনুষ্ঠান পালন ছাড়া দলের তেমন কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। দলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত আড়াই বছর সাংগঠনিক উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম না থাকলেও দলীয় সংসদ সদস্যদের কাছাকাছি থাকা কতিপয় নেতা-কর্মীর আর্থিক উন্নতি হয়েছে ঠিকই।
গত আড়াই বছরে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচি থেকে দূরে থাকা কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা দাবি করেছেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য দলীয় সংসদ সদস্য সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছেন। এ লক্ষ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির স্থগিত করা পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে দলের এক সভায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকা কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা দলের কার্যক্রম চাঙ্গা করতে এমপির কাছে সুপারিশ করেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এটা স্বীকৃত যে প্রতিটি সংসদ নির্বাচন, পৌর নির্বাচন আর ইউপি নির্বাচন, যে নির্বাচনই আসুক না কেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থীর তৎপরতা থাকেই। তবে গ্রুপিং সত্ত্বেও গত তিনটি পৌর নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি রফিউদ্দিন আহমেদ ফেরদৌস মেয়র নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছয় মাসের মাথায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সাধারণ সম্পাদক মো. আলতাফ হোসেনের পদ স্থগিত করা হয়। তাই গত আড়াই বছর তিনি দলীয় কর্মকাণ্ডে ছিলেন অনুপস্থিত। আবার এক বছরের মাথায় গিয়ে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে দলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান বাদশার দলীয় পদও স্থগিত করা হলে দলের মধ্যে আবার বিভক্তি দেখা দেয়। তবে মাসখানেক আগে দলের হাইকমান্ড আবার সাধারণ সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির পদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে ওই দুই নেতাকে স্বপদে ফিরিয়ে আনে। তবে উপর থেকে দলের এ দুই নেতার দ্বন্দ্ব নিরসন হলেও ভেতরে কতটা নিরসন হলো তা পরিষ্কার নয়। কেননা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বছরখানেক দলীয় অফিস যতটা সরগরম ছিল, এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, স্থানীয় শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কিছু নেতা-কর্মী গত আড়াই বছরে দলীয় কার্যালয়মুখী ছিলেন না। ফলে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে অনেকটাই ঢিলেঢালাভাবে। সাংগঠনিক কার্যক্রমের চেয়েও এমপি বেশ উদার রয়েছেন দলের কিছু সংখ্যক নেতা-কর্মীর ব্যাপারে। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মীর ক্ষোভ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. তাজউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, 'গত আড়াই বছরে দল ক্ষমতায় আসার পর দলের কার্যক্রমে গতি ছিল না। দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার অনুপস্থিতিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম বলতে গেলে স্থবির ছিল। এ সংকট নিরসনের চেষ্টা চলছে।'
এ ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম জালাল গত আড়াই বছর সাংগঠনিক কার্যক্রম তেমন ছিল না স্বীকার করে বলেন, দলের অভ্যন্তরে কিছুটা সমন্বয়হীনতা ও কয়েকজন সক্রিয় নেতা-কর্মীর পদ স্থগিতাদেশসহ নানা কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম তেমন জোরালো ছিল না। দলের এসব সমস্যা স্থানীয় সংসদ সদস্যের উদ্যোগে নিরসনের চেষ্টা চলছে। একটি সূত্র জানায়, স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান_এ চারজন জনপ্রতিনিধিই আওয়ামী লীগের নেতা। এমপি আর পৌর মেয়রের মধ্যে শুরুতে যে সমন্বয় ছিল, বর্তমানে তাতে কিছুটা চির ধরেছে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের আরেক ধারা শুরু হয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা মো. সাদিকুর রহমানের ওপর হামলা পর। লন্ডন প্রবাসী এই আওয়ামী লীগ নেতা ২৫ বছর পর দেশে এসে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলের সবার আন্তরিক সহযোগিতা নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কিছু দিন পরে দলের মধ্যে তাঁকে নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। এ বিরোধ শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্য কোন্দলে রূপ নেয়। ছাত্রলীগ-যুবলীগের কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মীর হামলার শিকার হন তিনি। প্রকাশ্য দিবালোকে উপজেলা পরিষদের ভেতরে ঢুকে মারধর করে তাকে নিজ কার্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়। নিজ দলের নেতা-কর্মীদের হাতে উপজেলা চেয়ারম্যান লাঞ্ছিত হলে দলের মধ্যে দুইটি পক্ষ দেখা দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রকাশ্য প্রতিবাদ জানান। এ ব্যাপারে পাল্টাপাল্টি মামলা করে উভয়পক্ষ। এ নিয়ে এখনো দলের মধ্যে বিরাজমান আছে দুই পক্ষে ক্ষোভ আর অবিশ্বাস। দলের প্রবীণ এ রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধার ওপর এ হামলার ঘটনায় দলীয় সংসদ সদস্য এমপি ও পৌর মেয়রের নীরব ভূমিকা নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সে দ্বন্দ্ব এখনো নিরসন হয়নি। উপরন্তু এ হামলার পর উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করা হয়। উপজেলা চেয়ারম্যানও তাঁর ওপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন।
তবে সম্প্রতি তাঁকে এমপির বাসভবনে এমপির সঙ্গে বৈঠকরত অবস্থায় দেখা গেছে। এ সময় উপজেলা চেয়ারম্যান সাদিকুর রহমান সাংবাদিকদের বিরদ্ধে বিষোদগার করে বলেন, সাংবাদিকরা উল্টাপাল্টা লিখে সংকট সৃষ্টি করছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগে কোনো দ্বন্দ্ব নেই দাবি করে তিনি বলেন, ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেছে। পেছনে কি হয়েছে, তা নিয়ে নতুন করে লেখার কিছু নেই। এ ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান বাদশা বলেন, 'গত আড়াই বছর দলের কর্মকাণ্ডে সরাসরি থাকতে পারিনি। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছিল। স্থানীয় এমপির উদ্যোগে ওই স্থগিতাদেশ সম্প্রতি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও পৌর মেয়র মো. রফিউদ্দিন ফেরদৌস হজ পালনের উদ্দেশে সৌদি আরবে অবস্থান করায় তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে দলীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আফজাল হোসেন বলেন, গত আড়াই বছর তো দলে পদ স্থগিত ছিল। সাংগঠনিক কাজে থাকতে পারিনি। এ সময়ে দলের কর্মকাণ্ড কেমন ছিল তা বলে লাভ কি। দলীয় পদ থেকে আমার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। সবাই মিলে এবার দলের সাংগঠনিক গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে চাই।

No comments

Powered by Blogger.