গৌতমের মৃত্যু নেই by পাশা খন্দকার

গৌতম দাস কোনো রাজসংসারে জন্মগ্রহণ করেননি। অতি সাধারণ মানুষরূপেই গৌতম দাস এই সমাজের মানুষ। সমাজ পরিবর্তনের জন্য কেউ কেউ অতি সাহসী হয়ে ওঠে, আমাদের চারদিকে প্রচণ্ড ঝড় তুলে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এই তেজোদীপ্ত তরুণ গৌতম দাস তার নিজ জীবনাচরণে, নির্ভীকতায় এবং একান্ত সত্য কথা বলার প্রয়োজনে সমাজের সব অসঙ্গতি দূর করার বৃহৎ স্বার্থে একজন দুঃসাহসিক কলমযোদ্ধার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন।


নিজের বিলাস-বৈভবের সাময়িক আনন্দে ক্ষুদ্র সংকীর্ণতার সঙ্গে আপস করলে অনেক ক্ষেত্রে বাঁচা যায়, সে বাঁচায় নিজেকে রক্ষাও করা যায়, কিন্তু ভালো কিছু সৃষ্টি হয় না। গৌতম মনে হয় এই বিষয়টা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে সব কালোর বিরুদ্ধে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করেছিলেন, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেও অতি সহজেই আলিঙ্গন করেছিলেন রূঢ় মৃত্যুকে। যে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একজন মানুষের শারীরিক উপস্থিতির সব কর্মকাণ্ডের বিলুপ্তি ঘটে, কিন্তু তার আদর্শ ও পথচলার সেই সাহসী ঘোড়া থেমে থাকে না, আগামী দিনের মানুষের দিকনির্দেশনার পথ দেখায়।
আমাদের এই প্রতিদিনের অতি চেনা শহর ও গ্রামের সব অনুজ এবং অগ্রজের সঙ্গে গৌতমের মধুর সম্পর্ক ছিল। সবার প্রতি তার একটি প্রচ্ছন্ন ভালোবাসা ছিল। দেখা হলেই একটু স্মিত হাসি দিয়ে কুশল বিনিময়ের মধ্যে একটা আপনত্ব জন্মে যেত। তাকে আমরা এই শহরে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেখেছি। এভাবেই তিনি নানা অসঙ্গতির তথ্য সংগ্রহ করে বেড়াতেন। যখন তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন, তখন থেকেই তার তেজোদীপ্ত লেখা আমাদের দৃষ্টিগোচর হতো। এভাবেই এই বিপদসংকুল সমাজে একজন নির্ভীক সাংবাদিকরূপে তার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। যখনই তার সঙ্গে নানা অসঙ্গতি নিয়ে কথা হতো তখনই দেখা যেত তিনি খুবই একরোখাভাবেই কথা বলতেন এবং যে কোনো রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্যি কথাটাই বলার চেষ্টা করতেন অবলীলায়। এ এক ধরনের মহৎ গুণ। কৃত্রিম অভিনয় করে সাহসী সাজা যায়, কিন্তু তাই বলে সাহসী হওয়া যায় না। আমাদের মনে হয়, এই নিভৃত পল্লীর গৌতম ছেলেবেলা থেকেই নিজের মধ্যে সাহস তৈরি করেছিলেন সমাজের চেহারা পরিবর্তনের প্রয়োজনে।
এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে 'সমকালের ফরিদপুরের ব্যুরো অফিসে' তিনি রাতযাপন করতেন। আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি কতিপয় ঘৃণ্য হন্তারক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার নোংরা ষড়যন্ত্রে নির্লোভ, নির্মোহ সাংবাদিক গৌতম দাসকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করবে। গুটিকয়েক নরপশু তার গলায় রশি বেষ্টন করে তার মৃত্যুকে নিশ্চিত করেছে।
তার হত্যার বিচারকাজ অতি মন্থরগতিতে এগোচ্ছে। তাকে হত্যা করা হয় ছয় বছর আগে ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর। দুর্ভাগ্যজনক যে, আমরা নিরুৎসাহিত বোধ করছি_ তার বিচারের প্রকৃত রায় কবে দেখব? দেশে স্বাধীনতার সপক্ষের সরকার, এরপরও এই দোলাচল কেন? আমাদের প্রশান্তি শুধু এটুকুই যে, নির্ভীক অকুতোভয় গৌতম দাসরা কখনও মরেন না। তারা কালো মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসেন অগি্নসূর্য হয়ে। গৌতম আছেন, থাকবেন হাজারো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সবার হৃদকুঠরিতে। তার এই মৃত্যুদিনে হাজার গৌতম জন্ম নিক_ এই প্রত্যাশাই আমাদের পাথেয়।

পাশা খন্দকার : উপদেষ্টা, সমকাল সুহৃদ সমাবেশ, ফরিদপুর

No comments

Powered by Blogger.