টিফা চুক্তির পোসল্টমর্টেম by গোলাম মোস্তফা

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টিফা বা ট্রেড অ্যান্ড ইনভেসল্টমেন্ট ফেদ্ধমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সম্প্রতি পত্রপত্রিকার খবরে প্রকাশ। এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে অনেক; সেই সঙ্গে ওই দেশে আমাদের পণ্যসামগ্রীর রফতানিও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল জে. ডিলেনি বিভিন্ন বৈঠকে আশ্বস্ত করেছেন।

এখন প্রশ্ন—চুক্তিটি বাংলাদেশের জন্য সত্যই কি প্রয়োজনীয়? এর মাধ্যমে আদৌ কি এ দেশের কোনো স্বার্থ রক্ষিত হবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন—এ চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে মার্কিনিরা এত আগ্রহী কেন? কোনো চুক্তিই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ এনে দিতে পারবে না। যদি এ ধরনের চুক্তি অজস্র বিনিয়োগের পথ খুলে দিত তাহলে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ফিদ্ধ-ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট সই করার পরিবর্তে টিফা চুক্তি করতে উঠেপড়ে লাগত। বস্তুত যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে টিফা চুক্তি সই করেছে সেগুলো হলো—পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও শ্রীলঙ্কাজাতীয় কয়েকটি দুর্বল রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ আসে ওদের ব্যক্তিখাতের মাধ্যমে। কোনো চুক্তিই ওদের ব্যক্তিখাতকে বেশি করে এসব দেশে বিনিয়োগ করতে উত্সাহিত করে না, যদি ওরা লাভ না দেখে। ওদের কাছে লাভটাই হলো মূল লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রের বড়-বড় তেল-গ্যাস কোম্পানি যখন এদেশে অতি সহজশর্তে গ্যাসক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছে তখন তো তারা টিফা চুক্তির জন্য বসে থাকেনি। এ চুক্তি সম্পর্কে সরকারের তরফ থেকে শুধু এটুকুই বলা হয়েছে, ‘টিফা স্বাক্ষরিত হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যের বিষয়গুলো দেখাশোনার জন্য যেরকম একটি যৌথ কমিশন রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সে আদলেই একটি কমিশন গড়ে উঠবে।’ তাদের ভাষায় টিফা নাকি এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু আসলে কি তাই? আপাতদৃষ্টিতে এ চুক্তিটিকে নিরীহ গোছের মনে হলেও আসলে কি এটি বিষহীন ঢোঁড়া সাপ? সম্প্রতি দেখা গেছে, নরওয়েসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ এবং চীন বাংলাদেশের সেবাখাতগুলোয় ঢুকে পড়েছে এবং ক্রমে এদেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করছে। প্রস্তাবিত এ চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হলো এ সেবাখাতগুলোয় দ্রুত প্রভাব বিস্তার করা। তাদের প্রচণ্ড আগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশে জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ ও বন্দরের দিকে। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে এসব খাতে তারা অনায়াসে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কারণেই চুক্তিটি স্বাক্ষর করার জন্য তাদের এত তোড়জোড়, এত চেষ্টা-তদবির। চুক্তিটি সম্পর্কে এ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে যতটুকু জানা গেছে সে সম্পর্কে একটু বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার, দেখা দরকার চুক্তির ধারা-উপধারায় দু’দেশের স্বার্থ সংরক্ষণে কী কী শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। টিফার একটি ধারায় বলা হয়েছে, ‘উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ আইন এবং অন্য কারও সঙ্গে সম্পাদিত যে কোনো চুক্তিতে তাদের অধিকার ও বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে যা-ই বলা হোক, এ চুক্তিতে উল্লিখিত বিধিবিধান সব সময়ই কার্যকর থাকবে।’ এ চুক্তির শর্তানুযায়ী এ দেশের সহায়সম্পদ ও জানমাল রক্ষা এবং তা সমৃদ্ধতর করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব আইনকানুন ও চুক্তি রয়েছে সেসব উপেক্ষা বা অবহেলা প্রদর্শন করে তাদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে হবে এবং কঠোরভাবে তা রক্ষাও করতে হবে। তাদের আকাগ্ধক্ষা, বাংলাদেশের সেবাখাতগুলো মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য পুরোপুরি খুলে দিতে হবে। অর্থাত্ বাংলাদেশের গ্যাস, বিদ্যুত্, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদিতে দেশীয় যে ন্যূনতম আবরণ আছে তা একেবারে উপড়ে ফেলে দিতে হবে। টিফা চুক্তির আরেকটি ধারাতে দু’দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু ‘সার্ভিস সেক্টরের’ কথা উল্লেখ রয়েছে। ‘গুডস’ বা ‘পণ্য’ তথা উৎপাদনের বিষয়টি সংযুক্ত নেই। চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করবে তা শুধু সার্ভিস সেক্টর বা সেবাখাতেই। তারা কোনো পণ্য এদেশে উত্পাদন করবে না। এতে বাংলাদেশের সেবাখাত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে পুরোপুরি বেসরকারি তথা মার্কিনিদের দখলে চলে যাবে। ফলে টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুত্, গ্যাস, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বন্দর প্রভৃতির ব্যবহারের মূল্য বস্লগুণ বেড়ে যাবে। তাই এ চুক্তি স্বাক্ষর করা হলে বাংলাদেশের জনগণের জন্য তা হবে জেনেশুনে বিষপান করার শামিল। এ চুক্তিতে ‘মেধাস্বত্ব অধিকার’ এবং ‘পরিবেশ’-এর বিষয়টি যেভাবে এসেছে তাতে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্ভাবন ও উচ্চমানসম্পন্ন পণ্য উত্পাদন করতে না পারলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। বলাবাস্লল্য, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক ছাড়া মানসম্পন্ন অন্য কোনো পণ্য রফতানির বিষয়টি স্বপেম্ন ছাড়া বাস্তবে সম্ভব নয়। তাছাড়া এ চুক্তি স্বাক্ষর হলে সংশ্লিষ্ট দেশ বা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ জীবনরক্ষাকারী কোনো ওষুধও প্রস্তুত করতে পারবে না। অথচ বর্তমানে অনুমতি ছাড়াই ওষুধ বা কোনো পণ্যের পেটেম্লট ব্যবহার করতে পারছে। চুক্তির কারণে পরিবেশ ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যাওয়া বাংলাদেশের আর সম্ভব হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। এ কারণে উন্নত দেশগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোচ্চার রয়েছে। টিফা স্বাক্ষর হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। শুধু এসবই নয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে বাংলাদেশ যে মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিল এ চুক্তি স্বাক্ষর হলে সে মর্যাদা হারিয়ে দালাল রাষ্ট্রের টাইটেল অর্জন করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। টিফায় আন্তর্জাতিক শ্রমমান ও অধিকার সংরক্ষণের যে ধারাটি জুড়ে দেয়া হয়েছে তার লক্ষ্য কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকারের স্বীকৃতি নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এদেশীয় পণ্যের রফতানি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণের জন্যই তা সংযোজন করা হয়েছে। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের কৃষিসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সব সম্ভাবনাময় খাত মার্কিনিদের অবাধ লুটপাটের জন্য শুধু ছেড়ে দিলেই হবে না; বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। কেবল সরকারি খাতে সফটঅয়্যার আমদানির জন্যই বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। আর বেসরকারি খাতের সফটঅয়্যারের হিসাব ধরলে এই ব্যয় বস্লগুণ বেড়ে যাবে। এভাবে কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার গচ্চা দিতে হবে। চুক্তির আরেকটি ধারায় দু’দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সব কর্মকাণ্ড যাতে স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পাদিত হয় সেজন্য ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’ নামে একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানি যাতে বাংলাদেশকে ঘুষ দিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে কোনো কাজ বাগাতে না পারে সেজন্যই চুক্তিতে এ ধারাটি সংযোজিত হয়েছে বলে প্রস্তাবকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এ ধরনের সান্ত্বনামূলক যুক্তি দিয়ে মার্কিন পক্ষ বাংলাদেশকে ওই শর্ত মেনে নিতে প্ররোচিত করেছে। অথচ ঘুষের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নিতে আমেরিকানরা যে বিশ্বখ্যাত তা কারও অজানা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর আগে অন্য যেসব দেশের সঙ্গে টিফা চুক্তি সই করেছে তার কোনোটিতেই এ ধরনের শর্ত সংযুক্ত নেই। কেবল বাংলাদেশই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এ ধারা সংযুক্ত রেখে চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ তথা সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণম্ন হবে। ঘুষ-দুর্নীতিপরায়ণ জাতি হিসেবে নিজেকে লিখিতভাবে স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে এজন্য বাংলাদেশকে প্রচুর খেসারত দিতে হবে। আসলে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর চরম অর্থনৈতিক মন্দার যে দ্রুত সম্প্রসারণ চলছে, তার ফলে বাজারের প্রভাববলয় নিয়ে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের আলামত ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে হস্তগত করা একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই দরকার। বিশেষত মালাক্কা প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ লাভে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান মার্কিনিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ উদ্দেশ্যেই তারা টিফা চুক্তি করতে উঠেপড়ে লেগেছে। টিফা চুক্তি বাংলাদেশের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আরও সহায়তা করবে তাতে, কোনো সন্দেহ নেই। এ নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু যে টিফা চুক্তি স্বাক্ষর করাচ্ছে তা নয়, এরা চারদলীয় জোট সরকারকে নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত চুক্তি, মেমোরেন্ডাম অব ইনটেম্লট (এমওআই) স্বাক্ষর করিয়েছে। এর আগের শেখ হাসিনার সরকারকে দিয়ে করিয়েছে হানা (হিউম্যানেটারিয়ান অ্যাসিসল্ট্যান্ট নিডস অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত চুক্তির ফলে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কোনো গবেষণা হাতে নিলেই বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড করতে চাইলে তা আগে ওয়াশিংটনকে জানাতে হবে। সুবোধ বালকের মতো সসম্মানে তাকে পেন্টাগনের হাতে তুলে দিতে হবে। হানা চুক্তির ফলে তথাকথিত মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন নির্ধারণ করতে মার্কিন সামরিক ব্যক্তিরা পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই এদেশে অবাধে যাতায়াত করতে পারবে। এ চুক্তির আমরা প্রত্যক্ষ কার্যকারিতা দেখলাম সিডরে আক্রান্তের সময় আমন্ত্রণ জানানোর আগেই মাকিন যুদ্ধজাহাজের আগমন এবং এদেশের কোনো কমান্ডের অধীন না হয়ে মার্কিন সেনাদের সম্পূর্ণ স্বাধীন কমান্ড প্রতিষ্ঠা। এতে এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের কতটুকু অক্ষুণম্ন থাকল! ৩০ লাখ শহীদের আত্মা কি এতে অপমানিত হলো না! টিফা, হানা, এমওআই, আইসিসি চুক্তিগুলো পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় এদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা এবং তাদের শোষণ-লুণ্ঠনের পথকে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্ন করা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই টিফা চুক্তি প্রতিরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী সব চুক্তি বাতিলে শাসকগোষ্ঠীকে বাধ্য করতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

No comments

Powered by Blogger.