সার্কের ২৬ বছর এবং কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা by ফরিদুল আলম

ময়ের পথপরিক্রমায় দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্ক ২৬ বছর অতিক্রম করতে চলেছে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শান্তি, সহযোগিতা, সমন্বিত আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান পর্যায়ের ১৬টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ ও কাল দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে সার্কের ১৭তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। দক্ষিণ এশিয়া নানা কারণেই বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করে।


এই অঞ্চলে বিশ্বের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মানুষের বাস, ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক ভাষার মানুষের বসবাস এবং প্রায় ১০টি মূল ধর্মাবলম্বী ছাড়াও জাতিগত, ধর্মগত, আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দক্ষিণ এশিয়া বরাবরই বিশ্ব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে আছে। এ অবস্থায় আসন্ন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়া তথা গোটা বিশ্ব। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে সার্ক কেবল একটি আঞ্চলিক সংস্থা নয়, বরং একটি আকাঙ্ক্ষার নাম। কারণ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করলেও এই অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তি ঘটেনি। বরং নানাবিধ অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ঘাত-প্রতিঘাতের নির্মম শিকার হতে হয়েছে। এই অবস্থায় সংগত কারণেই সার্ককে ঘিরে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি।
যদিও সার্কের মূলনীতি হলো, পারস্পরিক সহযোগিতা, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস এবং বোঝাপড়ার মাধ্যমে সমন্বিত উন্নয়নের পথে বাধাগুলোর উত্তরণ ঘটিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা; কিন্তু গত ২৬ বছরের পথপরিক্রমায় সার্কের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে রয়েছে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া। সার্কের প্রধান সাফল্যগুলো হলো_প্রথমত, এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সদস্য রাষ্ট্রগুলো আইনগতভাবে একে অন্যের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা নিশ্চিত হয়; দ্বিতীয়ত, সার্ক রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের বার্ষিক সম্মেলনে একত্র হওয়ার ফলে একে অন্যের নৈকট্য লাভ সহজ হয় এবং রাষ্ট্রগুলো বিদ্যমান উত্তেজনা প্রশমনে আরো মনোযোগী হয়; তৃতীয়ত, সার্কের টেকনিক্যাল কমিটি কর্তৃক প্রণীত সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ ও এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে সদস্য দেশগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হয়; চতুর্থত, নারী ও শিশু পাচার রোধকল্পে সম্মিলিত বোঝাপড়া আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হয়; পঞ্চমত, বৈশ্বিক জলবায়ুগত পরিবর্তন ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এর বিরূপ প্রভাব রোধকল্পে একত্রে কাজ করার নীতিগত সিদ্ধান্তের ফলে এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি নিরাপত্তা বলয় প্রতিষ্ঠা; ষষ্ঠত, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সার্কের ১৩তম সম্মেলনে গৃহীত সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়; সপ্তমত, সার্কের ১৪তম সম্মেলনে আফগানিস্তানকে নতুন সদস্যপদ প্রদানের মাধ্যমে সার্কের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। ওই সম্মেলনে পারস্পরিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে কানেকটিভিটি কার্যকরের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং এ কথাও বলা হয় যে প্রথমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এর বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে তা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করা সম্ভব হবে। এই কানেকটিভিটির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মুক্তভাবে পণ্য, সেবা, পুঁজি, সংস্কৃতি, জ্ঞান, প্রযুক্তি এবং জনসাধারণের অবাধ চলাচল নিশ্চিত হবে, যা উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
তা ছাড়া সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্যিক বৈষম্য রোধকল্পে দক্ষিণ এশীয় অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা সাপটা সার্কের আরো একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।
উপরোলি্লখিত অর্জনের পাশাপাশি সার্কের ব্যর্থতাও কম নয়। প্রতিষ্ঠার পর ২৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও সার্ক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি, দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব, জাতি ও ধর্মগত সংঘাত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো নিত্য ঘটনা সার্কের কার্যকারিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বারবার। এই অঞ্চলে কাশ্মীর সমস্যা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট শ্রীনগরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বোমা হামলা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাল্টা আঘাত সমস্যা সমাধানের পথকে কেবল প্রলম্বিতই করছে না, বৈশ্বিক জাতিগত দাঙ্গার ইতিহাসে নতুন মাত্রাও যোগ করছে। পাকিস্তানে সিয়া ও সুনি্ন সম্প্রদায়ের চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং পশতুন যোদ্ধাদের স্বতন্ত্র ইসলামিক পরিচয়ের দাবি, সেই সঙ্গে চলমান জঙ্গি হামলা কেবল দেশটির অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং সার্কের ভেতর পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্যতা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগার নেতা প্রভাকরনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশটির সরকারের সঙ্গে তামিলদের সংঘাতের আপাত অবসান হলেও তামিলরা তাদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে সরে আসেনি। সার্ক সনদের এক নম্বর অনুচ্ছেদে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে_'জনগণের কল্যাণ সাধন এবং তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো', অথচ সার্কভুক্ত দেশ ভারত ও পাকিস্তান তাদের জাতীয় বাজেটের যথাক্রমে ১৫ ও ৩০ শতাংশ (১৩১ বিলিয়ন রুপি) ব্যয় করছে সেনাবাহিনীর জন্য, এর বিপরীতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে ১.৬ ও ৩.২ বিলিয়ন রুপি। তাদের সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা যথাক্রমে ১১ লাখ ও ৬ লাখ। এ বাস্তবতার আলোকে তুচ্ছ জাতীয় স্বার্থ ত্যাগ করে সার্কের বৃহত্তর ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া দেশ দুটির জন্য কষ্টকর বটে। আর সার্কের প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো এর সনদের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদ; যেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে, 'দ্বিপক্ষীয় বিষয় সম্মেলনের আলোচনার আওতাভুক্ত হবে না।' সুতরাং আঞ্চলিক সহযোগিতার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও এই অঞ্চলের বড় দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের আন্তরিকতার অভাব সংগঠনটিকে কার্যত অচল করে রেখেছে।
সার্কের নানা ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই অঞ্চলের সত্যিকার উন্নয়নের স্বার্থে একে আরো কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে সার্কভুক্ত বড় রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানকে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। তাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষুদ্র জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ আপাতত স্বস্তিকর হলেও তা ভবিষ্যতের অনেক বড় অর্জনের সম্ভাবনাকে ম্লান করে দেয়। এবারের অনুষ্ঠিতব্য সার্কের মূল স্লোগান_'বন্ধুত্ব, শান্তি ও নিরাপত্তার সেতুবন্ধ' সত্যিকার অর্থে তখনই কার্যকর হবে, যখন সব সদস্য রাষ্ট্র তাদের ক্ষুদ্র জাতীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব উঠে সমন্বিত উন্নয়নের স্বার্থে একত্রে কাজ করবে, সেই সঙ্গে গত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবিত সন্ত্রাস মোকাবিলায় দক্ষিণ এশীয় টাস্কফোর্স গঠন এবং এ ক্ষেত্রে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবারের সম্মেলন আরো অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান বৈশ্বিক নির্ভরতার যুগে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে সব সমস্যা মোকাবিলা করে উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব নয়। সার্কের যেমন অনেক সমস্যা রয়েছে, তেমনি একটি অর্থবহ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় পরিণত করার মাধ্যমে এর সম্ভাবনাও রয়েছে অফুরন্ত। এই এলাকার বিশাল মানবসম্পদ, ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য_এ সব কিছুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বৈশ্বিক পরিসরে এর গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে বাড়াতে পারে। সেই সঙ্গে সার্ককে আরো গতিশীল করার জন্য প্রয়োজন প্রতিটি সার্ক সম্মেলন শেষে সার্কের ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন।

লেখক : চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.