শেয়ারবাজার-কারসাজির আশঙ্কাও অমূলক নয়

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার নিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যে ঘটনাপ্রবাহ ঘটে চলেছে, তা বোধ হয় বিশ্বে নজিরবিহীন। শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে ব্যবহৃত সব টোটকাই ব্যর্থ। কিসে বাজার পড়ে, আর কিসে বাজার ওঠে, সেটা নির্ণয় করা কঠিন। ঈদের আগে থেকেই বাজার ছিল নিম্নগামী। ঈদের পর সে বাজার ওঠেনি। ৯ দিন বন্ধ থাকার পরও ঠেকানো যায়নি বাজারের দরপতন। গত মঙ্গলবার বাজার নেমে যায় দুই বছর আগের অবস্থানে।


কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জরুরি বৈঠক ডাকার খবরে বুধবারই আবার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। মঙ্গলবার যে ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সাধারণ সূচক ২২৮ পয়েন্ট কমে হয় চার হাজার ৬৪৯ পয়েন্ট, সেই বাজারের সূচক বুধবার সকালে লেনদেন শুরুর পর পাঁচ মিনিটেই এক লাফে ২৪২ পয়েন্ট বেড়ে যায়। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তা ৩০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। দুপুর দেড়টায় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সাধারণ সূচক ৩০০ পয়েন্ট বেড়ে চার হাজার ৯৫০ পয়েন্টে দাঁড়ায়।
শেয়ারবাজারে কোনোভাবেই স্থিতি ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। এর পেছনে কাজ করছে আস্থার সংকট। আস্থাহীনতায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণ বাজারের ওঠানামা। একই সঙ্গে বাজার সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার কারণেও বাজার নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। আবার এই আস্থার সংকট একেবারেই অমূলক নয়। 'কম মূল্যে' শেয়ার কেনার জন্য কারসাজি করে পুঁজিবাজারে দরপতন ঘটানো হচ্ছে_এমন আশঙ্কাও একেবারে অমূলক নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের অনেকের ধারণা, শেয়ারবাজার যখন চাঙ্গা ছিল তখন অনেকে নানা কৌশলে তাদের পচা মাল বিক্রি করে বেরিয়ে গেছে। সুযোগসন্ধানীদের এই প্রবণতা নতুন নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা এখানেই। সেই ভূমিকা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কতটা পালন করেছে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। যে কম্পানির উৎপাদন বছরের পর বছর বন্ধ, সেই কম্পানি স্টক এঙ্চেঞ্জে তালিকাভুক্ত থাকে কী করে, তা সে যে গ্রুপেরই হোক না কেন? আর ওটিসি মার্কেটের অপব্যাখ্যা দিয়ে স্টক এঙ্চেঞ্জের অন্য কাউন্টারে পচা মাল বিক্রি হবে কেন? এসব প্রশ্ন এখন পুরনো হলেও প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়া গেলে বাজারের আজকের এই বেহাল দশার কারণ খুঁজে বের করা বোধ হয় কঠিন হবে না। শেয়ারবাজারের আজকের বেহাল দশার পেছনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসইসি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, এমনটিও অনেকে ধারণা করে থাকেন। আবার এমনও হতে পারে, কোনো না কোনোভাবে সংস্থাটির অসহায়ত্ব ছিল। তাদের দায়িত্ব হলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। বাজারে কোনো সমস্যা হলে প্রয়োজনে বাজার কখনো টেনে ধরা কিংবা ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু এসইসি কি সেই দায়িত্ব পালন করেছে?
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু প্রশ্ন আসে। বিশ্বের অন্যান্য শেয়ারবাজারের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, বাজারকে সহায়তা করার নানা ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশের শেয়ারবাজারে তেমন কোনো ব্যবস্থা কি আছে? প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী কারা? এর আগে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে গেলে সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক যৌক্তিক কিছু দায়িত্ব পালন করে। অনেকে শেয়ারবাজার নিম্নমুখী হওয়ার কারণ হিসেবে এটাকেও একটি কারণ বলে মনে করেন। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্তগুলো নেয় সেগুলো নেওয়া তার দায়িত্ব ছিল। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করার পর ব্যাংকগুলোর কোনো সমস্যা হলে তার দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর বর্তাত।
আমাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিনিয়োগের পরিমাণ একেবারে কম নয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিবেচনা করে শেয়ারবাজার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ এটা শুধু দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নয়, অনেকের কর্মসংস্থানেরও একটা জায়গা হিসেবে গড়ে উঠছিল।

No comments

Powered by Blogger.