সেই একই অভিযোগ-রোডমার্চ by নির্মল সেন

বেগম জিয়ার সিলেট ও রাজশাহী অভিমুখে রোডমার্চ শেষ হয়েছে। আমি বেগম জিয়াকে জিয়াউর রহমানের আমল থেকেই চিনি। জিয়ার আমলে বঙ্গভবনে গেলে রাষ্ট্রপতি জিয়া বেগম জিয়াকে ডেকে বলতেন, দেখ তো, নির্মল সেন বিয়ে করেন না কেন। জিয়ার মৃত্যুর পরে বেগম জিয়ার সঙ্গে আমার দু'বার দেখা হয়েছে। তিনি কুশলাদি জানতে চেয়েছিলেন। আমার শারীরিক অসুস্থতার কথা শুনে বলেছিলেন, আপনাকে আমি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠাব।


এরপর আমার বেশি অসুস্থতার কথা শুনে তার বড় ছেলে তারেক রহমানকে দু'লাখ টাকা দিয়ে আমার বাসায় পাঠিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে দু'লাখ টাকা দিয়েছিলেন। আমি এই দু'জনের কাছে কৃতজ্ঞ। আজকে বেগম জিয়ার যে রূপ দেখছি, এ রূপ আমি আগে দেখিনি। আজকে তিনি কথায় কথায় হুমকি দেন। আঙুল তুলে কথা বলেন। বর্তমানে রোডমার্চের জনসভায় যা ইচ্ছা তাই বলছেন। এর আগে তিনি সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার কথা বলেছেন। আমি লিখেছিলাম, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জিনিস নয়। আপনি সংসদ সদস্য। সংসদে গিয়ে কথা বলুন। সংসদে গেলে সংবিধান সংশোধন করা যায়। বাইরে বসে বলে লাভ নেই। বেগম জিয়া তার জনসভায় অনেক দুর্নীতি, মারামারি, বিশৃঙ্খলার কথা বলেছেন। কিন্তু নিজের আমলের কথা বলেননি। সত্য ঘটনা স্বীকার করলে তার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতো। তার বিরুদ্ধে সরকারি দলের অনেক নেতাই অনেক অভিযোগ উত্থাপন করছেন। তিনি সেসব অভিযোগের একটিরও জবাব দিচ্ছেন না। সরকারি দল থেকে বলা হচ্ছে, বেগম জিয়ার সব আন্দোলন যুদ্ধাপরাধী এবং তার ছেলেদের বাঁচানোর জন্য। বেগম জিয়া এ অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কোনো কথা বলেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি চান কি চান না_ তা স্পষ্ট করে বলছেন না। তার ছেলেদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না। শুধু সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, সবই সরকারের ষড়যন্ত্র। জিয়াউর রহমান যখন নিহত হন তখন তার হত্যার অপরাধে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে তখন একটি কথাও বলেননি। আমরা তখন অনেকের কাছে গিয়েছিলাম। একমাত্র তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুুস সাত্তার আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, এদের রক্ষা করা যাবে না। মেজর জেনারেল মনজুর হত্যাও রহস্যজনক। তাকে বর্মা সীমান্ত থেকে গোলাম কুদ্দুস নামে এক ওসি গ্রেফতার করেন। তারপর তাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আনা হয়। এ কথা শুনে আমার এক বন্ধু সাংবাদিক বলেছিলেন, নির্মলদা, শুনবেন যে ১ ঘণ্টার মধ্যে মনজুকে হত্যা করা হয়েছে। সত্যি সত্যি শোনা গেল, মনজুকে দেখে সেনানিবাসের এক দল সৈন্য ক্ষেপে যায় এবং তাকে হত্যা করে। এ রহস্যের জট আজও খোলেনি। এরপর বারবার বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু জিয়ার প্রিয়জন মনজু হত্যার বিচার বা কোনো সুরাহা হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে তিনি কিছু বলছেন না। আমি বেগম জিয়ার কাছে স্পষ্টভাবে জানতে চাই_ যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে তার বক্তব্য কী? তার আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। কেন হয়নি? মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের পত্নী হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধ করেছে তাদের বিচার করা। কিন্তু বারবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি এ কাজটি করেননি। আজকে যখন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনছে, তখন তিনি কেন জবাব দিচ্ছেন না? সরকারদলীয় লোকজন যখন বলছেন, খালেদা জিয়ার সব আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য, তখন তিনি কেন এর জবাব দিচ্ছেন না? বিবিসি বলেছে, খালেদা জিয়ার আমলে ৭শ' লোক র‌্যাবের হাতে মারা গেছে। এর একটিরও বিচার হয়নি। আপনি কিন্তু এ অভিযোগের জবাব দিচ্ছেন না। আপনার আমলে আওয়ামী লীগের একজন জনপ্রিয় নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার খুন হন। কিন্তু আপনি তার হত্যার বিচার করেননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আপনি প্রতিটি জনসভায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি সম্পর্কে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্য ও আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কে আপনার আমলের কথা মনে আছে তো? আপনার আমলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি উন্নত ছিল? আপনি মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এতে আপনার লাভ কী? আপনি তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। আপনি দাবি করছেন, নির্বাচন কমিশনার বদলাতে হবে। সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতিকে আপনারা ঘুষখোর বলেছেন। হিন্দুদের দেবী দুর্গা সম্পর্কে আপনি মন্তব্য করেছেন। আমি মনে করি, এ ধরনের মন্তব্য করা আপনার ঠিক হয়নি। শুনেছি, শেখ হাসিনা নাকি দুর্গাকে মা বলেছেন। আপনি তা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। আপনি বুঝতে পারেননি_ এ ব্যাপারে একটি সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হতে পারে। আর শেখ হাসিনা যে কথা বলেছেন, সে কথাও আমার কাছে ভালো মনে হয়নি। কারণ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে দেশটিকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি ইসলাম আর অন্যটি অন্যান্য সম্প্রদায়। বেগম জিয়া দ্রব্যমূল্য ও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছেন, বর্তমান সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে_এ কথা সত্য। এই সরকারের আমলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়_এটাও সত্য। এ পর্যন্ত র‌্যাবের হাতে দুইশ' লোক বিচারবহির্ভূতভাবে মারা যায়। তার কোনো বিচার হয়নি। বেগম জিয়া যদি রোডমার্চ সফল করতে চান, তাহলে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলতে হবে। তার ছেলেদের সম্পর্কে কথা বলতে হবে। যদি তারা দোষী হয়, তাহলে শাস্তি পাবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এই রোডমার্চ সম্পর্কে বিএনপি নেতা হান্নান শাহ বলেছেন, এই রোডমার্চ হচ্ছে গণসংযোগ। বিএনপির সঙ্গে জনগণের একাত্ম হওয়া। হান্নান শাহর কাছে আমার প্রশ্ন, এই রোডমার্চে তার কথা কি সত্য হবে? বেগম জিয়া যেসব কথা বলছেন তা সব পুরনো কথা। এসব কথা তার আমল সম্পর্কেও বলা যায়। হাজার হাজার গাড়ি নিয়ে, হাজার হাজার লোক নিয়ে, হাজার মাইল ঘুরে যা খুশি তা-ই বলে রাজনীতি করে লাভ হয় না। আমার মনে হয়, বেগম জিয়ার রোডমার্চ সেই পথেই যাচ্ছে।

নির্মল সেন : সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.