চরাচর-রাস উৎসব

চান্দ্রমাসের প্রথম দিনে যেদিন সন্ধ্যার আকাশে হেসে উঠেছিল এক চিলতে চাঁদ, সেদিন আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল মণিপুরিরা। এ পক্ষেই যেদিন আকাশের কোলজুড়ে হেসে উঠবে পূর্ণিমার চাঁদ, সেদিন মণিপুরিরা মেতে উঠবে রাস উৎসবে। অবশেষে এল সেই দিন। আজ মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা। প্রতিবছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় মহারাসলীলা উৎসব।


আর এই উৎসবকে ঘিরে আশ্বিন মাসজুড়েই মণিপুরি অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুর মণিপুরি পাড়ায় ঘরে ঘরে চলতে থাকে উৎসবের প্রস্তুতি। ধনী-গরিব এবং ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মণিপুরিদের রাস উৎসব আজ হয়ে উঠেছে সর্বজনীন এক উৎসব! স্থানীয় ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন তো বটেই, সুদূর ভারত থেকেও ছুটে আসে সেখানকার মণিপুরিরা। সাদা কাগজের নকশা আর নানা ফুলের আবরণে সজ্জিত মণ্ডপগুলো কী এক অমোঘ আকর্ষণে রাতভর ধরে রাখে হাজারো মানুষকে। আর সেই সঙ্গে মণিপুরি মেয়েদের নৃত্য সবার মনে ছড়িয়ে দেয় মুগ্ধতা। মণিপুরিদের এই মহারাস বলতে প্রেমরসকেই বোঝায়। বস্তুত রস শব্দ থেকেই রাস শব্দটির উৎপত্তি। রস আস্বাদনের লক্ষ্যে এই পূর্ণিমা তিথিতে রাধা-কৃষ্ণের লীলানুকরণে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে মণিপুরিরা যে উৎসব করে থাকে, তা-ই রাস উৎসব। এবার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরে মণিপুরি সম্প্রদায়ের এতিহ্যবাহী মহারাসলীলা উৎসবের ১৬৯তম বার্ষিকী এবং আদমপুরে ২১তম বার্ষিকী পালন হবে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৭৯ সালে মণিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রবর্তন করেছিলেন, তা-ই রাস উৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাদের বেশির ভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তাঁরা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশগ্রহণ করতেন। এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় আজ অবধি কোনোরূপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদ্যাপিত হয়ে আসছে মহারাস উৎসব। মণিপুরি এ নৃত্যকলা শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালে সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরিদের রাসনৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্যশিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জিকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা। উৎসব উপলক্ষে আজ মাধবপুর (শিববাজার) জোড়ামণ্ডপ ও আদমপুরের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মণ্ডপ প্রাঙ্গণে বসবে বিরাট মেলা। উৎসব ঘিরে সকাল থেকেই শুরু হবে নানা আয়োজন। রাখালনৃত্য (গোষ্ঠলীলা), আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গুণীজন সংবর্ধনাসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা, এরপর রাত। অনুষ্ঠান চলবে পরদিন ভোর পর্যন্ত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ রাতভর মেতে উঠবে এই আনন্দ উৎসবে।
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন

No comments

Powered by Blogger.