ব্যবচ্ছেদ-সীমিত আকাশ, তবুও প্রজাপতিটা উড়ল by দাউদ হোসাইন রনি

ছবির নাম : প্রজাপতি
পরিচালক : মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ
অভিনয়ে : মৌসুমী, জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, কচি খন্দকার, সোহেল খান প্রমুখ
মুক্তির তারিখ : ৭ নভেম্বর
রেটিং : ৩/৫


দর্শকের লাইন দেখে বুকে ভয় জাগে। বাংলা ছবি দেখার জন্য এত দীর্ঘ লাইন সর্বশেষ কবে দেখেছি, মনে নেই। বসুন্ধরা সিনেপ্লেঙ্ েআগামী তিন দিনের অগ্রিম টিকিটও নাকি সোলড আউট! এই যে এত দর্শক, এই দর্শকদের মন ভরাতে পারবে তো রাজ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো 'দর্শক'। চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা 'দর্শক নেই' বলে হা-হুতাশ করে মরছেন এক যুগ ধরে। নির্মাতারা তাই ফর্মুলা গল্প আর দৃশ্য সাজিয়ে নিম্ন আয়ের লোকজনের জন্য একধরনের বিশেষ ছবি বানিয়ে যাচ্ছেন, একের পর এক। কিছু দর্শক এই ছবিগুলোতেই অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু মাল্টিপ্লেঙ্ দর্শকদের কথা ভাবার সময়ই নেই নির্মাতাদের। বছরে বড় জোর দুই-একবার এই দর্শকরা হলে যাওয়ার উপলক্ষ খুঁজে পান। এই শ্রেণীর দর্শক কিন্তু বড়ই নিষ্ঠুর। কত ছবিই তো ছিল, মুক্তির আগে অনেক হাঁক-ডাক, অথচ সিনেপ্লেঙ্রে পর্দায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। কিন্তু এই ছবির প্রতি দর্শকের আগ্রহের কারণ কী? উত্তরটা এত সোজা না। ছবি দেখে বের হওয়ার সময় দেখা গেল কেউ কেউ গালাগালি করছেন, আবার কেউ বলছেন পরেরবার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এসে দেখে যাবেন। দর্শকের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্যের কারণে এমনটা হতে পারে। তবে দুই শ্রেণীর দর্শককে যদি একই সুতোয় বাঁধা যেত, কতই না ভালো হতো। তখন হয়তো, দুটি হলের পরিবর্তে ৫০টি হলে উড়ত প্রজাপতি।
জাহিদ একজন জুয়াড়ি। আয়-রোজগার নেই। বউ মৌসুমীর চাকরিতে সংসার চলে। জুয়াতে কখনো জিতেছেন_এমন রেকর্ড তাঁর নেই। তবু জুয়া খেলাতেই তাঁর যত আনন্দ। টাকার দরকার হলেই 'আই লাভ ইউ' বলে বউয়ের কাছে হাত পাতেন। মৌসুমীকে কখনো টাকা দিতে দেখা যায়নি। টাকা না পেলে পার্কে লেকের ধারে কাঁঠাল পাতা দিয়ে নিজে নিজেই জুয়া খেলেন। বড় বিজনেসম্যান মোশাররফ করিম এই দৃশ্য দেখে জুয়ার আসরে নিয়ে যান জাহিদকে। যত টাকা লাগবে তিনিই দিবেন। আর জাহিদও মনের আনন্দে হারতে থাকেন। এভাবে বেশ কিছুদিন চলতে থাকে। সর্বশেষ জুয়া খেলার দিনের ঘটনা অন্যরকম। জাহিদ কনফার্ম শেষ দান তিনিই জিতবেন। তাঁর হাতের কার্ড ভালো। মোশাররফ ভয় দেখান হেরে যাওয়ার। জাহিদ এতই ওভার কনফিডেন্ট যে নিজের বউকে বাজি ধরে মোশাররফের কাছ থেকে টাকা নেন। সোহেল খানের 'তিন টেক্কা'র কাছে সব কনফিডেন্স ধূলিসাৎ হয়ে যায় জাহিদের। পরে জানা গেল এ সবই মোশাররফের 'চাল'। বিয়ের আগে মৌসুমীর প্রেমিক ছিলেন তিনি। তাঁকে ফেরত পাওয়ার জন্যই এত আয়োজন। মৌসুমীর তখন দুদিকেই বসবাস, দুদিকেই টান। ফিরবেন কোন পথে? দুজনকেই ফাঁকি দিয়ে মৌসুমী প্রজাপতি হয়ে উড়ে গেলেন বহু দূরে।
গল্প ভালো। এমন গল্প নিয়ে খুব বেশি কাজও হয়নি এ দেশে। হাতে গুনেই বলে দেওয়া যায়। দুই যুগ আগে বিটিভিতে একটা নাটক প্রচারিত হয়েছিল 'বকুলপুর কত দূর' নামে, গত দশকে এ কে সোহেল নির্মাণ করেছিলেন 'বন্ধক' নামের একটি ছবি। হলিউডেও এই গল্প নিয়ে ছবি আছে। তবে রাজ নিজেই 'জুয়া' নামে একটি নাটক নির্মাণ করেছিলেন। সে নাটকের সম্প্রসারিত রূপই হলো 'প্রজাপতি'।
গল্প নিয়ে আপত্তি নেই। আপত্তি গল্পের প্রেক্ষাপট আর চিত্রনাট্য নিয়ে। শহরের প্রেক্ষাপটে এই গল্প কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। চিত্রনাট্য খুবই দুর্বল, অগোছালোও বলা যেতে পারে। চরিত্রগুলোকে দাঁড় না করিয়েই গল্প বলতে চেয়েছেন পরিচালক। মৌসুমী চাকরি করেন, কিন্তু কোথায়? মোশাররফ এত টাকার মালিক, তিনি আসলে কী করেন? সংলাপে এসেছে মোশাররফের বাবা-মা মৃত, জাহিদের বাবা-মা গ্রামে থাকেন। কিন্তু মৌসুমীর বাবা-মা কোথায়? আবার ছোটবেলায় একসঙ্গেই বড় হয়েছেন সমবয়সী (!) মোশাররফ আর মৌসুমী। ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হলো, মোশাররফ বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁর প্রেমিকা মৌসুমীকে। তার আগেই মৌসুমী এনগেজমেন্ট সেরে ফেলেছেন জাহিদের সঙ্গে। তাহলে কি ধরে নেব, মৌসুমী অভিনীত চরিত্রটি 'হিপোক্রেট'? গল্পের শেষে সেই হিপোক্রেট চরিত্রের মুখ থেকে 'সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ' কথাটা ঠিক মানায় না। নাকি, এটা তাঁর নিজেরই উপলব্ধি ছিল? মৌসুমীর দিকে তাকিয়ে থাকায় কোনো এক ছেলেকে কঠিন মারা মেরেছেন মোশাররফ। মৌসুমী তখন বললেন, 'তোর মতো সাইকো ছেলেকে বিয়ে করার কোনো মানে হয় না'। যদিও সে মারামারির দৃশ্য দর্শক দেখেনি। দৃশ্যের চেয়ে সংলাপে ভরসা রেখে গল্প এগিয়ে নিয়েছেন পরিচালক। মৌসুমীর চুল আর জাহিদের শেভ না করা চেহারার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি। ধরলে এ রকম আরো অনেক খুঁতই বেরিয়ে আসবে। বারবারই মনে হচ্ছিল, আরো কিছু দৃশ্যের শুটিং বাকি ছিল। কোনো কারণে পরিচালক সেটা করতে পারেননি। তবে সমসাময়িক ছবির সঙ্গে তুলনা করলে এ ছবির ভালো দিকটাই বেশি চোখে পড়বে। প্রথমত, ঝকঝকে পর্দা। বেশির ভাগ সময়ই একটা লাল টোন ছিল, সেটা কি ইচ্ছাকৃত না প্রযুক্তিগত ত্রুটি, ধরা যায়নি। এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে যাওয়ার সময় এডিটিংয়ের যে খেলাটা ছিল, সেটা দেশীয় চলচ্চিত্রে একেবারেই নতুন। ভালো লেগেছে। সিনেমাটোগ্রাফি সুন্দর। বেশি ভালো আরফিন রুমির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। দৃশ্যের মুড ভালোই ধরতে পেরেছেন তিনি। সংলাপ বেশ মজার। এই মজার কারণে দর্শকের ক্লান্তি আসেনি। কোরিওগ্রাফি মোটেও ভালো হয়নি। তবে গানগুলো ভালো হওয়ায় সেটা চোখে লাগেনি। সেট মানানসই। জুয়ার আসরের অ্যারেঞ্জমেন্ট সুন্দর। অভিনয়ে জাহিদ হাসান ভালো করেছেন। মৌসুমী চলনসই। মোশাররফ করিম ক্লোজ শটে চমৎকার, ওয়াউড অ্যাঙ্গেলে বেশ আড়ষ্ট। গানের দৃশ্যে ভালো লাগেনি তাঁকে। দেশীয় ছবিতে সাধারণত দেখা যায়, প্রধান চরিত্রগুলো বাদে আর কারো অভিনয়ই চোখে পড়ার মতো হয় না। এই ছবির ছোট চরিত্রের অভিনেতারা বরং অনেক ভালো করেছেন। মেকিংয়ে [গানের দৃশ্য বাদে] উপমহাদেশীয় রীতি ফলো করা হয়নি। এখানেই 'বাহবা' আদায় করে নিয়েছেন পরিচালক। বাচ্চারা [স্পিলবার্গের মতে, উপমহাদেশীয় দর্শকরা নাকি এখনো শিশু দর্শক] তো দুধই খেতে চাইবে। তাই বলে কি তাদেরকে একটু-আধটু মাছ-মাংসের স্বাদ দিতে হবে না!

No comments

Powered by Blogger.