চালচিত্র-তিস্তা চুক্তিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ by শুভ রহমান

দেশের এখানে-সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু আশার আলো জ্বললেও তিস্তা চুক্তিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো নয়। নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। খোদ সরকারের ভেতরের লোক, শাসক আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রিসভার পুনর্মূল্যায়ন চেয়েছেন। মুখর উপদেষ্টা ওবায়দুল কাদেরও। বিরোধী দলকে তাঁরা ছাড় দেবেন না, কিন্তু সরকারের ব্যাপারেও তাঁরা দুর্মুখ। সরকারের ভেতরের সমালোচনা ক্রমেই আরো স্পষ্ট হচ্ছে।


এদিকে বাজারে কয়েকজন মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগের গুজব। যাহোক জ্বালানি তেলের আবার মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুতের দাম বাড়ার সম্ভাবনা, পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি ও তার ফলে আবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা, ভর্তুকি প্রত্যাহার, মূল্যস্ফীতি_এসব লক্ষণ ভালো নয়। নরসিংদীর মেয়র হত্যা ও তদসংক্রান্ত ব্যাপারে সরকারি ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আবার মহাজোটের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় থাকতে শুধু মন্ত্রিসভা বা মহাজোট নয়, দেশের সার্বিক পরিস্থিতিরই পুনর্মূল্যায়ন করে দ্রুত দেশের সর্বোচ্চ জনকল্যাণের লক্ষ্যে প্রতিকারমূলক ও গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে।
তিস্তা পরিস্থিতি
সর্বাগ্রে আসে তিস্তা চুক্তির কথাই। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে দ্বিতীয়বার আশাহত হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরের প্রথমভাগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ বড় আশা করেছিল, তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারেনি। তবে বলা হয়েছিল, সেটি পরিত্যক্ত হয়নি, আলোচনার টেবিলেই আছে। মমতা সফরসঙ্গী না হওয়ায় সেবার মনমোহন সিং বিব্রত হয়েছিলেন। দুই দেশেরই সরকারি নেতারা বারবার আশা দিয়েছিলেন, শিগগিরই চুক্তি স্বাক্ষর হবে, হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এখনো আশাবাদী বলেই মতপ্রকাশ করছেন। বুধবার (১৬ নভেম্বর, বিকেল ৫টায়) তাঁর কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সরকারি বৈঠকে কথা বলার তথ্য দিয়েছেন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ। আড়াই মাস কেটে গেছে। মালদ্বীপে সম্প্রতি সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে আশা করা গিয়েছিল, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ ব্যাপারে কিছু পজিটিভ আশ্বাস পাওয়া যাবে। যায়নি। সম্মেলনের বাইরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে সামান্য আলোচনা হলেও মনমোহন সিং ভারতীয় সংবিধানের কথা বলেছেন। সংবিধান অনুযায়ী, এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য থাকতে হবে। তাঁরা সে জন্য মমতাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসহ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা বারবার কলকাতা গেছেন, কিন্তু মনমোহনের ভাষায়, 'উই আর সাম ডিসট্যান্স অ্যাওয়ে ফ্রম তিস্তা প্যাক্ট' (তিস্তা চুক্তি থেকে আমরা কিছু দূরে রয়েছি)। তিনি বলেছেন, 'ইট উইল বি টু আর্লি' (এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়)। বাংলাদেশের সঙ্গেও ঐকমত্যের চেষ্টা হচ্ছে বলেই তিনি জানিয়েছেন। তবে শিগগির চুক্তি হচ্ছে না, এটাই ছিল তাঁর মোদ্দা কথা। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যাওয়ার আগে ঈদুল আজহার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শুধু তিস্তা নয়, আরো ৫৩টি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়েই আলোচনা হবে। আর জেআরসি তো আলোচনা করেই যাচ্ছে। সার্কে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা আলোচনার সুযোগ নেই, তবে পৃথক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনা হবে। আলোচনা হয়েছে, কিন্তু শিগগির চুক্তি হচ্ছে না_এমনটাই মনমোহন সিং আভাস দিয়েছেন। তবে ঢাকার কোনো কোনো জাতীয় দৈনিকে মন্তব্য করা হয়েছে, চুক্তির ব্যাপারে ভারত আন্তরিক। মালদ্বীপ থেকে মনমোহন সিং দেশে ফেরার সময় বিমানে সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলেছেন, তাতে কলকাতার সাংবাদিকরা খুব একটা আশাবাদী হতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
তবে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ মঙ্গলবার (১৫.১১.২০১১) বেঙ্গালুরুতে তিস্তা চুক্তি আসন্ন (রাউন্ড দ্য কর্নার) বলে জানিয়েছেন। বেঙ্গালুরুতে তিনি ভারত মহাসাগর 'রিম' অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশনের ১১তম মন্ত্রী-বৈঠকের প্রাক্কালে সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় এই মন্তব্য করেন। ডা. দীপু মনিও সে বৈঠকে যোগ দিতে বেঙ্গালুরুতে ছিলেন।
যাহোক, আমরা মনে করি, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ছাড়া দুই দেশেরই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হতে পারে না।
পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ, দুটোই মূলত নদীমাতৃক ভূখণ্ড। নদী ব্যাপকভাবেই দুই অঞ্চলের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। কত গান, কবিতা, কথাসাহিত্য রচিত হয়েছে দুই দেশের নদীকেন্দ্রিক জীবন নিয়ে। পদ্মা নদীর মাঝি, গঙ্গা, তিতাস একটি নদীর নাম_এমন বিখ্যাত সব উপন্যাস, পল রবসনের 'কলোরাডো, ও কলোরাডো', ভূপেন হাজারিকার অমর গান 'ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন' কিংবা কিছু চলচ্চিত্র ইত্যাদি নদী কিভাবে একটি অঞ্চলের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়, তার অমর দলিল হয়ে আছে।
নদী ছাড়া চলবে না আমাদের প্রতিবেশী দুই দেশের মানুষের। তিস্তা আর গঙ্গা হচ্ছে দুই দেশের দুটি প্রধান নদীব্যবস্থা। তাদের পানির ন্যায্য হিস্যা দুই দেশকে পেতেই হবে। আন্তর্জাতিক নদী আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দুই দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পানিবণ্টনের স্থায়ী চুক্তি ছাড়া দুই দেশের অগ্রগতির পথ ব্যাহত হতে বাধ্য। ইউরোপ-আমেরিকার ক্ষেত্রে কলোরাডো, দানিয়ুব, রাইন, ভলগা, রাশিয়ার ডন নদী, আফ্রিকার মিসরের নীল নদ একাধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। সব আন্তর্জাতিক নদীরই পানির হিস্যা নিয়ে বিভিন্ন দেশের সমঝোতা ও চুক্তি রয়েছে। সবারই সেচব্যবস্থা, কৃষি-অর্থনীতিসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভরশীল অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের ওপর। সেসব দেশের মধ্যে বিরোধ নেই, তাদের নৌপথও সহযোগিতা এবং বৈধ অধিকারের ভিত্তিতেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলো দীর্ঘকাল ব্যবহার করে চলেছে।
আমাদেরও চুক্তি তাই হতেই হবে অভিন্ন সব নদী নিয়ে। গঙ্গা চুক্তি হয়েছে, কিন্তু তার সফল বাস্তবায়ন অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।
ভাটির দেশের উপযুক্ত ব্যবস্থা
বাংলাদেশ ভাটি অঞ্চল। এ দেশের অভিন্ন সব নদীর উৎস প্রতিবেশী দেশে। শুধু ভারতে নয়, নেপাল, ভুটান, চীন_সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের পানির ন্যায্য হিস্যাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট ভারতবিদ্বেষী নীতির কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি এক রকম উপেক্ষাই করেছে, বিরোধ জিইয়ে রেখেছে নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে। আজও বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতার নীতি তারা ত্যাগ করেনি। কিন্তু বিশাল গণম্যান্ডেট পাওয়া রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সমুন্নত রাখতে ভারতসহ সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে অভিন্ন নদী সমস্যাসহ সব বিরোধ ও সমস্যা চিরতরে মিটিয়ে ফেলতে হবে। মহাজোট ক্ষমতায় থাকতে থাকতে এ কাজ সমাপ্ত না হলে আবারও দেশ এক অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে যেতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের মতো বাংলাদেশেরও নদীই হচ্ছে প্রাণ। ভয়াবহ পরিবেশদূষণ, অসচেতনতা, নদীগুলোকে সব সময় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্য রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের ঐকান্তিক মনোযোগের নিদারুণ অভাব_এসব কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো নিজেরাই মরতে বসেছে, মানুষের প্রাণ বাঁচাবে কী করে! তার পরও জরুরি ভিত্তিতে সব অভিন্ন নদীর পানির ন্যায়সংগত বণ্টন (ইকুইটেবল শেয়ারিং) নিশ্চিত করার মাধ্যমে একদিকে, বিশেষ করে, শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ যেমন সচল ও সর্বাধিক (অপটিম্যাল) রাখতে হবে, তেমনি বর্ষা মৌসুমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের মানুষ, প্রাণী, গাছপালা, সম্পদের ভয়াবহ বিনাশও দৃঢ়ভাবে রোধ করতে হবে। ভারত তিস্তার উজানে বাঁধ দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে এবং বর্ষা মৌসুমে পানি ছেড়ে দিয়ে আমাদের জন্য সীমাহীন সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ফলে ১৯৯৩ সালে 'ডালিয়া পয়েন্টে' তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করে সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা বাংলাদেশের বিফলে গেছে। পানি যেখানে আমাদের অমূল্য সম্পদ, সেখানে উদ্যমহীনতা, অসচেতনতা, দেশপ্রেমের অভাব আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক দৃঢ় না করার কারণে নদীই এ জাতির বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীকে বাঁচাতে হবে এবং নদীই এ জাতিকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলবে, ভরে তুলবে সম্পদে এবং ঐশ্বর্যে।
প্রস্তাবনা
অভিন্ন নদী সমস্যাসহ দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা, যোগাযোগব্যবস্থা, ভর্তুকি, মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, শেয়ারবাজারের নৈরাজ্য ইত্যাদিসহ বর্তমান সময়ের সব জরুরি সমস্যা আলোচনা এবং একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য অবিলম্বে বিরোধী দল, দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, নারী প্রতিনিধি, শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত প্রতিনিধির জাতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হোক, সরকারি উদ্যোগেই।
১৬.১১.২০১১

No comments

Powered by Blogger.