বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা by ড. তুহিন ওয়াদুদ

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটি দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ভূমি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আর বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধান করার মহান দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের। প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদ অলংকৃত করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক-স্থানীয় হিসেবে বিবেচিত।


অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীর প্রতি আমাদের আস্থার স্থানটি খুব পুষ্ট। উপাচার্য হিসেবে যখন দুবার তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন তাঁর দৃঢ়তা, সততা এবং নিষ্ঠা আমাদের মুগ্ধ করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যদিও দেশের উচ্চশিক্ষা এবং মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সংযোগকারী প্রতিষ্ঠান, তবুও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওপর নির্ভর করে, তেমনি সরকারও উচ্চ শিক্ষার বিস্তারে এ প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে। ফলে মধ্যবর্তী এ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। সাধারণত যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন যাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বিমত থাকে তাঁদের এ পদে ওই সরকার অধিষ্ঠিত করে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিয়োগ পেলেও রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি দেয়নি। সেটা মহাজোট সরকারের বিচক্ষণতা বলতে হয়। তবে বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যপদ থেকে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিবর্তে দলবাজি করার একটি উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান ক্রমশ নিম্নমুখী করে তুলছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশিষ্ট্যগত কারণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দলবাজির বিরোধিতা করার সুযোগ হয়তো কম। তবুও অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী নিশ্চয়ই পারবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই দলবাজির বিপক্ষে উচ্চকিত কণ্ঠস্বর হতে। আমরা তাঁর কাছে এ প্রত্যাশাটুকু রাখি। সাধারণত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারের সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিচয় না থাকার কারণে অধিক যোগ্যতাসম্পন্নদের চাকরি না দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্নদেরও চাকরি দেওয়া হয়। তাহলে পরিবর্তিত সরকার ক্ষমতায় এলে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারদলীয় কোনো প্রার্থীকে কেন চাকরি দেবে? এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেধাবীদের অগ্রাধিকার না দিয়ে দলীয় প্রার্থীকে প্রাধান্য দেওয়ার মধ্যে হয়তো ব্যক্তির চেয়ে দলকে বড় করে দেখা হয়, কিন্তু দলের চেয়ে দেশকে বড় করে দেখা হয় না। আমরা মনে করি, উপাচার্য থাকাকালীন ড. এ কে আজাদ চৌধুরী যেমন দলের ঊধর্ে্ব থাকতে পেরেছিলেন, এবারও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে আমাদের প্রত্যাশার অন্ত নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনজনিত কারণে প্রণীত আইনের বিপক্ষে অনেক সময় যাওয়ার সুযোগ থাকে না। ব্যক্তি কখনো মতনিরপেক্ষ হয় না। সচেতন মানুষের ক্ষেত্রে তো সে ভাবনা একেবারেই অবান্তর। অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীরও রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে; কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা, তিনি যেন দলীয় স্বার্থের ঊধর্ে্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে সমুন্নত করেন। আমরা আশাবাদী যে তাঁর সময়ে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা তথা গবেষণার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কিছু কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। দেশে যেসব নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, সেগুলোর শিক্ষার মান উন্নত করতে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ খুবই প্রয়োজন। দেশ-বিদেশের মেধাবী শিক্ষকদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলো গঠনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের বড় অভাব। দেখা যাচ্ছে, একই পদের জন্য কখনো কখনো একাধিকবার বিজ্ঞপ্তি দিতে হচ্ছে। যদি পাওয়া যায়, তবু হয়তো আবেদনকারীদের সংখ্যা এত কম থাকে যে ভালো যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ থাকে না। সে ক্ষেত্রে বিশেষত ঢাকার বাইরে যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠছে, সেগুলোতে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা না রাখলে মেধাবী এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকদের এসব প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাবে না। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সামান্য পরিমাণ বাজেট দেওয়া হচ্ছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজেট থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। দেশের নতুন-পুরনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা থাকে না। যদি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে না পারে, তবে দেশের সরকারি কলেজের লেখাপড়ার সঙ্গে খুব বেশি পার্থক্য থাকবে না। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরতে চাইলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার জন্য বড় ক্ষেত্র হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির কথা গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। বর্তমান চেয়ারম্যান বিদায়ী চেয়ারম্যানের এই অসমাপ্ত কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নেবেন_এটিই প্রত্যাশা।
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধে শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকার যদি দিনের পর দিন বেসরকারিভাবে শিক্ষাবিস্তার উৎসাহিত করে, তাহলে শিক্ষা হয়ে উঠবে ধনিক শ্রেণীর সম্পদ। রাষ্ট্র দেশের সব শিক্ষার্থীর শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করবে_প্রত্যাশা খুব সঙ্গত। শিক্ষার মতো একটি মৌলিক চাহিদা পূরণে সরকারের ব্যর্থতা আমাদের প্রত্যাশা নয়। দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে যত্রতত্র সম্মান কোর্স চালু করে শিক্ষার মান ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। দেশে সরকারি কলেজে যেখানে সম্মান শ্রেণীতে পাঠদানের শিক্ষকের অভাব, ঢাকা শহরের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য যোগ্য শিক্ষক পাওয়া কঠিন হচ্ছে, সেখানে উপজেলা পর্যায়ে কিংবা জেলা পর্যায়ের বেসরকারি কলেজগুলোতে যে হারে সম্মান কোর্স চালু হচ্ছে, তাতে শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে পেঁৗছবে বলা কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী উচ্চ শিক্ষার বহুমাত্রিক সংকট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে জ্ঞাত। সুতরাং তাঁর অকুণ্ঠ আন্তরিক প্রচেষ্টায়ই উচ্চ শিক্ষা প্রাণ লাভ করবে_এ আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.