মানুষ মানুষের জন্যে... by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

লে গেলেন যাযাবর শিল্পী ভূপেন হাজারিকা। গত ৫ নভেম্বর পরলোকগমন করেন তিনি। ভূপেন হাজারিকাকে স্মরণ করে নন্দনের পাঠকদের জন্য লিখেছেন গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানচলে গেলেন কিংবদন্তি সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব ড. ভূপেন হাজারিকা। সন্দেহ নেই, উপমহাদেশের সঙ্গীতজগতে এ ক্ষতি অপূরণীয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর দু'মাস প্রায়।
গত ৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কক্ষে প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় তিনি তার ৮৫তম জন্মদিন পালন করেন বহু কষ্টে এক টুকরো কেক মুখে দিয়ে। মুম্বাইর কোকিলাবেন ধিরুভাই আম্বানি হাসপাতালে ৫ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। জীবনের অধিকাংশ সময় প্রগতিশীল সংগ্রামী এই মানুষটি ৪ মাস মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে দুটি কিডনিই অকার্যকর হয়ে যাওয়াসহ মালটিপল অর্গান ফেইলিউরের কারণে চলে যান চিরবিদায় নিয়ে। তবে সব মৃত্যুই জীবনকে পরাজিত করতে পারে না। ভূপেন হাজারিকা মৃত্যুর পরও জীবিত থাকবেন। এই উপমহাদেশসহ বিশ্বের অগণিত মানুষের অন্তরে বহুকাল-কালান্তরে। ভূপেন হাজারিকার সারা জীবনের একমাত্র পরাজয় সম্ভবত শেষ জীবনে এসে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বিজেপিতে যোগদান, যা তার প্রগতিশীল সংগ্রামী সত্তার বিপরীত বিন্দুতে অবস্থিত।
আসামের সাদিয়া জেলায় ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভূপেন হাজারিকার জন্ম। গৌহাটি থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর বানারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৪৪ এবং ১৯৪৬ সালে। এরপর তিনি আমেরিকা চলে যান এবং কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে গণযোগাযোগ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ফেলো হিসেবে শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন।
ভূপেন হাজারিকার সঙ্গীতজীবনের শুরু তার বাল্যকাল থেকেই। নিজে গান রচনা করে সুর দিয়ে গেয়ে বেড়াতেন অনেকটা চারণ কবির মতো। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি অসমিয়া চলচ্চিত্রে
গান গেয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ক্রমে অসমিয়া ভাষা ছাড়িয়ে বাংলা এবং হিন্দি অর্থাৎ সর্বভারতীয় পর্যায়ে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন তিনি। তবে তার সঙ্গীতজীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যময় সময় অবশ্যই ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত ৬টি বছর। এ সময় তিনি আমেরিকার বিপ্লবী, প্রতিবাদী কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পী পল রবসনের সানি্নধ্যে আসেন এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। বহু সংখ্যক অমর গাথা সঙ্গীতের [ব্যালাড] স্রষ্টা পল রবসনের প্রভাবে উজ্জীবিত হন ভূপেন হাজারিকা। ব্যালাড হলো অনেকটা ধর্ম, জাতি, বর্ণ বা সামাজিক অবস্থানগত বৈষম্য, নিপীড়ন নিয়ে শোক-ক্ষোভ এবং বিদ্রোহের বিবরণমূলক গাথা সুরে সুরে বিবৃত করা। দরাজ, গম্ভীর, উদাত্ত শক্তিশালী কণ্ঠের অধিকারী পল রবসনের 'সং অব ফ্রিডম', 'সং অব লিবার্টি', 'গোইং হোম', 'দ্য ভলগা বোটসম্যান', 'ওল ম্যান রিভার', 'ওভার দ্য মাউনটেন্স', 'পাসিং বাই', 'দ্য ব্লাইন্ড প্লাউম্যান', 'লেট মাই পিপল গো', 'সামার টাইম'সহ আরও বহু গান অমর হয়ে আছে। পল রবসনের 'ওল [ওল্ড] ম্যান রিভার' যারা শুনেছেন, তারা সহজেই বুঝবেন ভূপেন হাজারিকার 'ও গঙ্গা বইছো কেন' গানটির ওপর কী সর্বাত্মক প্রভাব রয়েছে ওই গানটির। যেমন সুরে, গায়নভঙ্গিতে, তেমনি ভাব এবং বিষয়গত দিকেও ভূপেন হাজারিকার গানটি পল রবসনের গানের ছায়া বলে মনে হয়। এছাড়া ব্যালাড ধরনে রচিত এবং গীত ভূপেন হাজারিকার প্রায় সব গানই পল রবসন দ্বারা অনুপ্রাণিত। বলা যেতে পারে, চারণস্বভাবী ভূপেন হাজারিকার সঙ্গীতজীবন পল রবসনের স্পর্শে যেন এক নতুন দিগন্ত খুঁজে পায়। পল রবসন [১৮৯৮-১৯৭৬] তার জীবনে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দেখেছেন, অনুপ্রাণিত হয়ে গেয়েছেন মানুষের গান। লোকসঙ্গীতের আঙ্গিককে অসাধারণ দক্ষতায় তিনি ব্যবহার করেছেন তার গানে। 'ব্যালাড' সিঙ্গার হিসেবে সারা বিশ্বে আজও কেউ তাকে অতিক্রম করে যায়নি। ভূপেন হাজারিকার গাথা-সঙ্গীতের মোড় ঘুরে যায় এই মহান শিল্পীর সংস্পর্শে এসে।
ভূপেন হাজারিকা, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে যার সঙ্গীত প্রতিভার প্রকাশ ঘটে, তার সঙ্গীতজীবন বলা যেতে পারে ৮০ বছরব্যাপী। আসাম থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গে অতঃপর সারা ভারতে যেমন, তেমনই প্রায় সমগ্র বিশ্বে তার সঙ্গীতভ্রমণ। জীবনকে তিনি দেখেছিলেন মানুষের সংগ্রামের জ্বালানি হিসেবে। এবং পরিণত বয়সের প্রায় সমস্তটাই তিনি ব্যয় করেছেন সেই প্রয়োজনেই। বিশ্বমানবতা এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতি নিবেদিত ছিল তার সঙ্গীতসত্তা। অসমিয়া, বাংলা, হিন্দিসহ ভারতের আরও কিছু ভাষা এবং এমনকি চলচ্চিত্র সঙ্গীতেও তার যত গান, সেসবের অধিকাংশই মানবতাবাদী। বাংলায় আমার শোনা তার অর্ধশতাধিক গানের মধ্যে 'মানবতা', 'প্রভাতি পাখিরা কেন গায়', 'ইতিহাস আমি ইতিহাস', 'পথে নামো আলোকের সেনা', 'সহস্র জনে মোরে প্রশ্ন করে', 'মানুষ মানুষের জন্য', 'জিন্দাবাদ ম্যান্ডেলা', 'মোরা এক তরীর যাত্রী', উই আর অন দ্য সেম বোট', 'কৃষ্ণ কায়া ও আফ্রিকা মোর', 'শেষ কবিদের মাত্রা', 'আমি ভালোবাসি মানুষকে', 'আমায় একজন সাদা মানুষ দাও', 'ও গঙ্গা বইছো কেন', 'আমার গানের হাজার শ্রোতা', 'আমি এক যাযাবর', 'দোলা', 'সাগর সঙ্গমে', 'এ সাহারা প্রান্তর', 'ও বিধি আমায় কালো করলে যদি', 'ভারতেরই মাটির ঘরে', 'দুটি পাতা একটি কুড়ি', 'আমরা করবো জয়', 'আজ জীবন খুঁজে পাবি', 'সমাজের অগ্রগতির', 'এক বাও মেলে না', 'গঙ্গা আমার মা', 'প্রতিধ্বনি শুনি', 'ও মালিক সারা জীবন'সহ আরও কিছু গানে তার মানবতাবাদী উচ্চারণ স্পষ্ট। ভারতের গাথা-সঙ্গীত অর্থাৎ ব্যালাডের উদ্যোক্তা হয়তো তাকে বলা যাবে না, কারণ বিশেষত বাংলায় চারণকবি মুকুন্দ দাস [১৮৭৮-১৯৩৪] তার বহু আগে থেকেই গণজাগরণের গান গেয়ে বেড়িয়েছেন গ্রামগঞ্জে, শহর-বন্দরে। এমন কি গণনাট্য সংঘের জন্য সলিল চৌধুরী যেসব কালজয়ী গান করেছেন_ যেমন, বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, রানার, গাঁয়ের বধূ, পালকির গান প্রভৃতিও ভূপেন হাজারিকার আগের। তবে মুকুন্দ দাস সর্বভারতীয় পর্যায়ে তেমন পরিচিত ছিলেন না_ আর সলিল চৌধুরী নিজে ছিলেন না গায়ক।
পথিকৃৎ না হলেও ভূপেন হাজারিকা নিজস্ব যে ক্ষেত্রটি তৈরি করে নিয়েছিলেন সেখানে গাথা-সঙ্গীতে তার অবদান চিরস্মরণীয়। তা ছাড়া ভূপেন হাজারিকা এক জীবনে বহুবিধ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রযোজক-পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, অভিনয় করেছেন। গায়ক হিসেবে অবশ্যই তিনি ভারতের আবেগপূর্ণ বর্ণনাত্মক গাথা-সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ পরিবেশক। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য যেমন ১৯৯২ সালে তিনি 'দাদা সাহেব ফালকে' পুরস্কার অর্জন করেন তেমনি সঙ্গীতে অবদানের জন্য ২০০১ সালে অর্জন করেন 'পদ্মভূষণ' উপাধি। এছাড়া ২০০৯ সালে তার ৮৩তম জন্মদিনে আসাম সরকার তাকে ভূষিত করেন 'আসামরত্ন' উপাধিতে। এছাড়া আসাম সরকার তাকে ২০০৭ সালে আজীবন সম্মাননা হিসেবে প্রমথেশ বড়ূয়া পদক প্রদান করে। ভূপেন হাজারিকার জীবনে পুরস্কার এবং সম্মাননা প্রাপ্তি শুরু হয় আরও অনেক আগেই। আঞ্চলিক ছবির শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৭ সালে পদ্মশ্রী উপাধি প্রাপ্ত হন। তিনিই প্রথম ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক, যিনি 'রুদালী' ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার জন্য 'এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার' প্রাপ্তির সম্মান অর্জন করেন ১৯৯৩ সালে। সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ সম্মানের 'মুক্তিযোদ্ধা পদক ২০১১' [মরণোত্তর] ঘোষণা করেছে তার জন্য। বাংলাদেশেও তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন স্বাধীনতা-পরবর্তী ছবি 'সীমানা পেরিয়ে'তে ১৯৭৭ সালে। এই ছবির দুটি গান 'মেঘ থম থম করে' এবং 'বিমূর্ত এই রাত্রি আমার' স্মরণীয় হয়ে আছে। এর মধ্যে 'মেঘ থম থম করে' গানটি ভূপেন হাজারিকার স্বকণ্ঠে গীত। অক্ষয় কীর্তির জন্য তিনি অনন্তকাল মানুষের অন্তরে সম্মানের আসনে স্থায়ী থাকবেন_ এ কথা আজ নিদ্বর্িধায় বলা যায়।

No comments

Powered by Blogger.