ভাসানী : তোমাকে যেন ভুলে না যাই by গাজীউল হাসান খান

সাম্রাজ্যবাদ কিংবা সামন্তবাদ, আধিপত্যবাদ কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর যেকোনো অপশাসন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনতার যে নেতার দুটি সংগ্রামী হাত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে খোলা তরবারির মতো বারবার ঝলসে উঠত, ১৭ নভেম্বর সে নেতার ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের ইতিহাসে এক আপসহীন সংগ্রামী নেতার নাম, যিনি ভোগের নয়, ত্যাগের ও আদর্শের রাজনীতি করে ৯৬ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন।


আমরা যারা ভাসানীর শেষ বয়সে তাঁর সঙ্গে পেশাগত কিংবা বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম, তাদের কাছে একটি পরম তৃপ্তি কিংবা সুখের বিষয় এই যে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পেরেছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা রেখে যেতে পেরেছিলেন একজন রাজনৈতিক মহীরুহের মতো। দেশীয় ও বৈশ্বিক কী ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা শেষ পর্যন্ত কী দেশ পেয়েছিলাম এবং মুক্তিযুদ্ধকালে এর নেতৃত্ব কারা কিভাবে দিয়েছিলেন, সে বিতর্কে না গিয়েও এ কথা দৃপ্তকণ্ঠে বলা যায় যে উপমহাদেশের তৎকালীন সবচেয়ে বর্ষীয়ান ও প্রভাবশালী জননেতা মওলানা ভাসানী জনতার চূড়ান্ত সংগ্রামে কোনোভাবেই পিছিয়ে ছিলেন না। ব্রিটিশ ভারতে যুবা বয়স থেকে উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকালে বৃহত্তর স্বাধীন (যুক্ত) বাংলা প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন তিনি অন্তরে লালন-পোষণ করেছিলেন, একাত্তরে (পূর্ব পাকিস্তানের) বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তাঁর সে আকাঙ্ক্ষা হয়তোবা তাঁকে একেবারে হতাশ করেনি। একটি মুক্ত বা স্বাধীন দেশে একাত্তরের ২২ ডিসেম্বর পা রাখতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর প্রয়াত রাজনৈতিক সহকর্মী শরৎ বসু, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমসহ অন্য যাঁরা ১৯৪৭ পূর্ববর্তী সময়ে ভারত কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগদান নয়, বরং একটি স্বাধীন যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছিলেন, তাঁরা শেষ পর্যন্ত সাফল্যমণ্ডিত হননি। মওলানা ভাসানী ছাড়া শেষ পর্যন্ত তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাও দেখে যেতে পারেননি। বাংলাদেশের আগামী ৪১তম বিজয় দিবসকে সামনে রেখে তাই একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আজ মওলানা ভাসানীর বিশাল সংগ্রামী জীবন বারবার বিভিন্নভাবে এক ধারাবাহিকতার ইতিহাস হিসেবে স্মৃতিপটে জেগে উঠছে।
ভারতের খ্যাতনামা ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেওবন্ধ মাদ্রাসায় ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের পর মওলানা মাহমুদুল হাসানের মতো বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদের অনুপ্রেরণায় ভাসানী ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দিয়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণকালে ভাসানী ব্রিটিশ প্রশাসনের হাতে গ্রেপ্তার হন। সেই থেকে পরাধীনতা, অন্যায়, অবিচার ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ সংগ্রাম এবং কারাজীবন শুরু হয়। একজন মওলানা হয়েও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন। সে কারণেই তাঁর পক্ষে ১৯১৯ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেওয়া মোটেই কঠিন হয়নি।
১৯৫৩-এর ৪ ডিসেম্বর রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রশ্নে গঠিত হয়েছিল 'ন্যাশনাল ডেমোক্রেটি ফ্রন্ট' (এনডিএফ)। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানে অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক নির্বাচন ঘনিয়ে আসে। মওলানা ভাসানীর দল, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গঠিত হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। মওলানা ভাসানী ও অন্যদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে সে নির্বাচনে বিপুল ভোটে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সে বিজয়কে বানচাল করে নবগঠিত সরকারটি ভেঙে দিয়েছিল। তখন একমাত্র ভাসানী ছাড়া শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং এমনকি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পেঁৗছেছিলেন। সে অবস্থায় ১৯৫৬ সালের ৭ মে থেকে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য খাদ্য বিতরণের দাবিতে মওলানা ভাসানী এক দীর্ঘ অনশন ধর্মঘট শুরু করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আয়োজিত বিখ্যাত কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন বৈষম্য ও শোষণ-বঞ্চনার অভিযোগে ভাসানী 'আস্সালামু আলাইকুম' বলে তাদের বিদায় জানিয়েছিলেন। সেটি পক্ষান্তরে ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বাধীনতার এক বেপরোয়া ডাক। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি নাকচ করা এবং মার্কিন সমর্থিত সামরিক জোট সেন্টো ও সিয়াটোতে (ঈঊঘঞঙ ধহফ ঝঊঅঞঙ) যোগদানের প্রশ্নে বাম ধারার রাজনৈতিক নেতা ভাসানী ডান ধারার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মতভেদের কারণে সব রকম দলীয় সম্পর্ক ছেদ করেন এবং ১৯৫৭ সালের ৫ জুলাই ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন প্রগতিশীল ও বাম ধারার রাজনৈতিক দল গঠন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনসহ ভাসানীর অন্যান্য দাবি সমর্থন করলেও শেখ মুজিবুর রহমান তখন সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আওয়ামী লীগেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই থেকে দলীয়ভাবে দুই নেতার বিচ্ছেদ ঘটলেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট থাকে।
আওয়ামী লীগে পরিবর্তনের এক বছরের মধ্যেই সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান। গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমান, যা স্থায়ী হয়েছিল ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৩ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে মারা গেলে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের পূর্ণ নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত তাঁকে কয়েকবারই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মওলানা ভাসানীকে সে সময় টাঙ্গাইলের মির্জাপুর হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের দুই বছর পর তাঁকেসহ ৩৪ জন বাঙালির বিরুদ্ধে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' নামে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মওলানা ভাসানী এর বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে তথাকথিত মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ অন্যদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৯ সালে এক গণ-আন্দোলনের ডাক দেন। দেখতে দেখতে ছাত্র-জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণে সে আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল। তাতে সেনাশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ও তাঁর প্রায় ১০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং শেখ মুজিবসহ অভিযুক্তরা মুক্ত হন। এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন। সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সব কয়টি আসন ও জাতীয় পরিষদের জন্য নির্ধারিত দুটি বাদে সব আসনেই জয়লাভ করে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করেছিল। সে নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর দল কিছু আসনে জয়লাভ করার সম্ভাবনা থাকলেও তিনি তা বয়কট করেন। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা, কোনো অবস্থায়ই ভাসানী তখন নিজ দলকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে চাননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরেই একজন দায়িত্বশীল প্রবীণ নেতা হিসেবে তিনি যে দাবিটি উত্থাপন করেছিলেন তা হলো, অবিলম্বে ভারতের সৈন্যবাহিনী ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার। বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে দায়িত্ব নেওয়ার পরও মওলানা ভাসানী একজন দায়িত্বশীল দেশপ্রেমিক নেতার মতো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং ইস্যুর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনীতি ছিল অনেকটা যেন একে অপরের সম্পূরক, যা সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারত না। ভাসানী কখনোই বঙ্গবন্ধুর কোনো অকল্যাণ কামনা করেননি। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার রাজনীতি করলেও তিনি চেয়েছিলেন শেখ মুজিবের মধ্য দিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্নের বাস্তবায়ন। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ভাসানী কোনো দিনই রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। তিনি সব সময় জনগণের মধ্যে অবস্থান করতে চেয়েছিলেন। সে অবস্থানে থেকেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি নিশ্চিত জানতেন; হাজার মাইলের ভৌগোলিক ব্যবধানে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অঞ্চল ও ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে কোনো দিনই এক রাখা সম্ভব হবে না। তাই ১৯৪৭-এর বিভক্তির আগেই তিনি ও তাঁর তৎকালীন সহকর্মীরা বাংলা এবং আসামের বাঙালি প্রধান কয়েকটি জেলা নিয়ে একটি পৃথক ও বৃহত্তর স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া '৭৪-এর পরও ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন কিংবা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ভাসানী প্রকাশ্যেই স্বাধীনতার দাবি তুলেছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু নির্বাচন ও আন্দোলন, এ দুয়ের মধ্য দিয়েই সার্থকভাবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন সে বৃহত্তর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'হুজুর' নামে খ্যাত সাধারণ মানুষের এ নেতা আজ সব চাওয়া-পাওয়ার অনেক ঊধর্ে্ব চলে গেছেন। তাঁর সারা জীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রামী আদর্শ এবং অসাধারণ অবদানকে আমরা যেন ভুলে না যাই। সব দলীয় স্বার্থ এবং সংকীর্ণ চিন্তার ঊধর্ে্ব উঠে আমরা যেন ভাসানীকে তাঁর যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে ভুলে না যাই। তা না হলে আমরা কখনোই আমাদের দীনতা ও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব না।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.