নিষিদ্ধ হয়েও থেমে নেই হিযবুতের কার্যক্রম by রেজোয়ান বিশ্বাস ও এস এম আজাদ

নিষিদ্ধ হলেও জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্‌রীরের কার্যক্রম থেমে নেই। বর্তমানে সংগঠন সক্রিয় রেখেছেন এর শীর্ষপর্যায়ের ১৩ জন নেতা। এসব নেতার কেউ কারাগারে, কেউ পলাতক, আবার কেউ বিদেশে থেকে দলীয় কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। তাঁদের তত্ত্বাবধানে সদস্য হিসেবে সংগ্রহ করা হচ্ছে শিক্ষিত, মেধাবী এবং বয়সে তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রদের। নীতিগত অবস্থানে ভিন্নতা থাকলেও বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল নেপথ্যে থেকে জঙ্গিদের শক্তি ও সাহস জোগাচ্ছে। হিযবুতকর্মীরাও আছে সেই দলে। গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে এসব জঙ্গি রাজধানীতে প্রকাশ্যে মিছিল-সমাবেশও করছে। পুলিশ ও র‌্যাবের একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।


র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ সোহায়েল কালের কণ্ঠকে বলেন, র‌্যাব গত দুই বছরে চার শীর্ষনেতাসহ হিযবুত তাহ্রীরের ৫৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। সর্বশেষ গত ২৭ জুলাই মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে হিযবুত তাহ্রীরের সিনিয়র উপদেষ্টা মাহমুদুল বারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি আরো বলেন, 'যেকোনো জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা শুরু হলেই র‌্যাব অভিযান চালায়। নিষ্ক্রিয় থাকলে বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকলে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় না।'
পুলিশ জানায়, নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে গত ১৩ আগস্ট মুক্তাঙ্গনে সমাবেশের প্রস্তুতি নেয়। এ লক্ষ্যে রাজধানীতে রঙিন পোস্টার লাগানো এবং লিফলেট বিলি করে হিযবুতকর্মীরা। ১৩ আগস্ট সমাবেশ করতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে হিযবুতকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রাদি শফিক, মনিরুল ইসলাম পিয়াস, জামিলুর রহমান, সাবি্বর আহমেদ ওরফে আকাশ, শাহাবুদ্দীন, শরীফ শাহ মিরাজ, আসিফ রহমান, সৈয়দ জাইম আবদুল্লাহ, সাইয়েদুল ইসলাম, আহম্মেদ নিজাম, সাফায়েত উল্লাহ শাওন, হাবিবুর রহমান, আশিকুর রহমান, জাহিদুল ইসলাম, ফয়সাল ও জাহেদ উদ্দীন নামের ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ১০ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাকিরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গত রবিবার তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
পল্টন থানার ওসি শহীদুল ইসলাম রবিবার কালের কণ্ঠকে জানান, ১৩ আগস্ট মুক্তাঙ্গনে সমাবেশের চেষ্টা করার পর থেকে হিযবুত তাহ্রীরের পলাতক শীর্ষনেতাদের খুঁজছে গোয়েন্দারা। পল্টন মোড়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর হিযবুতের ১৬ কর্মীকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এরই মধ্যে তাদের কাছ থেকে হিযবুতের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের ওপর নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মীদের হামলার ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে গত ১৪ আগস্ট দুই মামলায়ই আদালতে ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত রবিবার তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় তিন দিনের এবং পুলিশের ওপর হামলার মামলায় এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
হিযবুতের কার্যক্রম সম্পর্কে পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০০২ সালে প্রথম কমিটি গঠন করে হিযবুত তাহ্রীর। ওই বছর বিদেশি অর্থায়নে বাংলাদেশে পরিচালিত একটি এনজিওর উত্তরা কার্যালয়ে হিযবুতের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। ২০০৩ সালের মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে হিযবুত। ২০০৯ সালের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হিযবুত তাহ্রীরকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে শনাক্ত করে। ওই বছরের ২২ অক্টোবর বাংলাদেশে এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। সংগঠনটির ১৩ সদস্যের ওই কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জেলে রয়েছেন। ওই কমিটিতে যুগ্ম সমন্বয়কারী কাজী মোরশেদুল হক, সিনিয়র উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মাওলা, রাজনৈতিক উপদেষ্টা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শেখ তৌফিক, গণসংযোগসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা মামুনুর রশীদ এবং মিডিয়া ও প্রচারসচিব করা হয় অধ্যাপক মুস্তফা মিনহাজকে। কার্যকরী সদস্য করা হয় সাখাওয়াত হোসেন, মামুনুর রশীদ আনসারী, আহাম্মদ জামান, ডা. সাঈদ, মনির হোসেন, ডা. গোলাম মোস্তফা ও শাহজালাল মিয়াকে। এ ছাড়া মহিলা শাখার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফাহমিদা ফারহানা খানম। ধানমণ্ডির ১৫ নম্বর সড়কের ৯/এ নম্বর বাড়ির এআইবিটির তৃতীয় তলায় গড়ে তোলা হয়েছে মহিলা শাখার কার্যক্রম।
সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক গোয়েন্দা রিপোর্টে হিযবুতের জঙ্গি তৎপরতার কথা জানতে পারে। ২০০৩ সালে ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ২৩৪ নম্বর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের খায়রুন্নেসা ভবনে তাদের নিজস্ব অফিসে হিযবুত তাহ্রীরের কার্যক্রম চালাতে সহায়তা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করে। রাজধানীতে অন্তত ১৩টি আস্তানায় কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে হিযবুত। বর্তমান সরকারের আমলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বিপুল পরিমাণ জিহাদি বই, লিফলেট, ট্রেনিং বেল্ট, বিভিন্ন দেশের জঙ্গি প্রশিক্ষণের ভিডিও ফুটেজসহ কয়েকজন শীর্ষপর্যায়ের জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়। গ্রেপ্তারের পর জেএমবির প্রধান সাইদুরসহ কয়েকজনের দেওয়া তথ্যে জামায়াতসহ কিছু দলের সঙ্গে হিযবুতের যোগাযোগের বিষয় প্রকাশ পায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি, হারকাতুল জিহাদ (হুজি), জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) হিযবুতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। হিযবুতের গ্রেপ্তার হওয়া ১৬ সদস্যও জিজ্ঞাসাবাদে এ রকম তথ্য দিয়েছে বলে জানা গেছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে হিযবুতের দুই শতাধিক সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই পরে জামিনে বেরিয়ে এসেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর ডাক দিয়ে প্রচারপত্র বিলি করছে হিযবুত তাহ্রীর। এসব প্রচারপত্র বিলিসহ নানা জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহার করা হচ্ছে শিক্ষিত তরুণদের। এখনো নিউ মার্কেট এলাকায় সভা করে হিযবুত। তাদের আস্তানা ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জ ও সাভারে ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছরের ১৬ আগস্ট হিযবুত তাহ্রীর ৪৪ পৃষ্ঠার একটি খসড়া দলীয় সংবিধান প্রকাশ করে তা বিভিন্ন গণমাধ্যম কার্যালয়ে পাঠায়। 'খিলাফত রাষ্ট্রের খসড়া সংবিধান' নামে 'হিযবুত তাহ্রীর, বাংলাদেশ'-এর ওই কার্যক্রম প্রশাসনকে ভাবনায় ফেলে। প্রচারণায় হিযবুত জানায়, তারা বর্তমান প্রচলিত শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জঙ্গি নিয়ন্ত্রণ সেলের কার্যক্রম ও অভিযান শুরু হওয়ার পর কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে হিযবুত। তবে শীর্ষপর্যায়ের পলাতক ও কারাগারে থাকা ১৩ নেতাই বিভিন্নভাবে কর্মীদের সংগঠিত করছেন বলে জানা যায়। মাঠে তাদের হয়ে কাজ করছে কিছু অনুসারী।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত এক বছরে রাজধানীতে দলীয় প্রচার ও তৎপরতা চালানোর সময় গ্রেপ্তার হয় অর্ধশত তরুণ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেধাবী এবং বেপরোয়া মনোভাবের ছাত্রদেরই টার্গেট করে হিযবুত। তাদের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডে এ ধরনের কর্মীই দেখা যায় বেশি। সম্প্রতি বিলির সময় প্রায় ৫০০ লিফলেটসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন কর্মী নাওয়াত আশেকিন। তিনি বনানীর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ শেষ সেমিস্টারের ছাত্র। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে লিফলেট বিলি করার সময় গ্রেপ্তার করা হয় রাশেদ জামিল চৌধুরীকে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। মোহাম্মদপুর সাতমসজিদের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ছাত্র রিয়াজকে। তিনি সিএতে পড়ছেন। গত ৩১ জানুয়ারি পল্টন ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে হিযবুত তাহ্রীরের প্রায় এক হাজার সদস্য প্রকাশ্যে মিছিল করে। তাদের বেশির ভাগই ছিল ছাত্র। ১ ফেব্রুয়ারি পল্টন থানার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র ফাহাদ আজিম, আরিফ রব্বানী ও তেজগাঁও কলেজের ছাত্র সাইফুল ইসলাম জানান, সংগঠনের কার্যক্রম আগের চেয়ে বেড়েছে।

No comments

Powered by Blogger.