আহ! অমৃত স্বাদ by সাবি্বর নেওয়াজ,

দেখলেই জিভে আসে জল! মুখে দিলেই মনে হয় অমৃত! জ্বাল দেওয়া খাঁটি দুধের ছানা, চিনি আর এলাচের মৌতাত গন্ধে নিমেষেই মেতে ওঠে মন। স্বাদে জুড়ায় জিহ্বা। রসনাবিলাসে এদেশীয় মিষ্টান্নের মধ্যে এক নামে একে সবাই চেনেন। একদিকে রয়েছে আড়াইশ' বছরের ঐতিহ্য, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। বহুল আলোচিত এ মিষ্টান্নের নাম 'নাটোরের কাঁচাগোল্লা'। নামে গোল্লা শব্দটি থাকলেও এটি আকারে কিন্তু কোনো গোল মিষ্টান্ন নয়। লম্বা বা চ্যাপ্টা তো নয়ই। বিয়ে-শাদি, প্রথম সন্তানের মুখ দেখা, কনে দেখা, অতিথি আপ্যায়নসহ যে কোনো সামাজিক ও ধর্মীয় আনন্দ-উৎসবে নাটোরের কাঁচাগোল্লা প্রাণ জুড়ায় ভোজনরসিক বাঙালির।


নাটোরের মিষ্টি কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৭৬০ সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। জনশ্রুতি মতে, প্রায় দুই শতাব্দী আগে শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের কয়েকটি প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকানের মধ্যে সেরা। মধুসূদন দেড় থেকে দু'মণ ছানা দিয়ে বিভিন্ন রকম মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন অন্তত ১৫ কর্মচারী। একদিন কোনো কারিগর আসেননি। মধুসূদনের মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এ চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানায় তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখেন। এরপর দেখা যায় চিনি মেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে_ এ নিয়ে শুরু হয় চিন্তাভাবনা। যেহেতু চিনির রসে ডোবানোর আগে ছানাকে কিছুই করতে হয়নি অর্থাৎ কাঁচা ছানাই চিনির রসে ঢালা হয়েছে, তাই তার নাম হয়েছে 'কাঁচাগোল্লা'। আরও
কিংবদন্তি রয়েছে, নাটোর এস্টেটের তৎকালীন মহারাজা রসগোল্লা সরবরাহের জন্য নির্দিষ্ট এক ময়রার দোকানে নির্দেশ দেন। এরপর তিনি রসগোল্লার জন্য বারবার তাগাদা দিতে থাকেন। মহারাজার তাগাদার মুখে তাড়াহুড়া করতে থাকেন কারিগররা। এক পর্যায়ে ভুল করে বসেন তারা। এদিকে এ ভুলের খবর পেঁৗছে যায় মহারাজার কাছে। মহারাজা তখন নির্দেশ দেন যা হয়েছে তা-ই সরবরাহ করতে হবে। অথচ তখন পর্যন্ত কারিগররা ছানায় গোল আকার দিতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে সেই ছানায় চিনি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে সরবরাহ করা হয়। পরে অবশ্য নতুন ধরনের এই মিষ্টি খেয়ে সবাই তারিফ করতে থাকেন। কাঁচা ছানা চিনির রসে মিশিয়ে জ্বাল দেওয়ায় এবং গোল্লা করতে গিয়ে ভুল হওয়ায় এর নাম হয়ে যায় কাঁচাগোল্লা। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৮৪০ সালের দিকে দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ননাথ রায়ের আমলে শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন উৎসবের দিনে উপস্থিত ধর্মপরায়ণ সবাইকেই এক বেলচা করে কাঁচাগোল্লা বিতরণ করা হতো। সে সময় প্রতি সের কাঁচাগোল্লার দাম ছিল মাত্র ৩ আনা।
কাঁচাগোল্লার সন্ধানে নাটোরের মিষ্টি কারিগরদের কাছে ধরনা দিলে তারা এ প্রতিবেদকের সামনেই কাঁচাগোল্লা তৈরি করে দেখান। নাটোর শহরের লালবাজার এলাকার বিখ্যাত জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কারখানায় দেখা গেল কাঁচাগোল্লা তৈরির প্রক্রিয়া। কাঁচাগোল্লা বানাতে লাগে খাঁটি দুধের ভালো ছানা, চিনি এবং পরিমাণমতো এলাচ দানা। এক কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে ৭০০ গ্রাম চিনি লাগে। চিনি কড়াইতে সামান্য পানিসহ গুলিয়ে তাপ দিলে চিনির গাদ বা ময়লা কেটে যায়। বেশি পরিষ্কার করতে সামান্য কাঁচা দুধ দিলে প্রায় সব ময়লা কেটে যায়। কড়াই থেকে গাদ বা ময়লা তুলে কড়াইয়ে ছানা ঢেলে দিতে হয়। ৩০ থেকে ৪০ মিনিট জ্বাল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। এর মধ্যে ২-৩টি ছোট এলাচ দানা ছেড়ে দিলেই পরিপূর্ণ কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে যায়। কাঁচাগোল্লার স্বাদে রয়েছে মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ, যা অন্য কোনো মিষ্টান্নে পাওয়া যায় না।
নাটোরের কিছু উল্লেখযোগ্য দোকান ছাড়া প্রকৃত কাঁচাগোল্লা মিলবে না। লালবাজারের মধুসূদন পাল প্রতিষ্ঠিত জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, জয়কালীবাড়ি সংলগ্ন দ্বারিক ভাণ্ডার, নীচাবাজারের কুণ্ডু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, অনুকূল দধি ও মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, স্টেশন বাজারের নয়ন ও সকাল-সন্ধ্যা। দামেও এ মিষ্টান্ন সুলভই বলা যায়। প্রতি কেজি মাত্র ২৮০ টাকা। জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বর্তমান স্বত্বাধিকারী প্রভাত পাল জানান, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান এবং দেশের বাইরে, বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পর্যটকরা নাটোর এসে ফেরার সময় কাঁচাগোল্লা নিয়ে যেতে ভুল করেন না। শীত মৌসুমে নাটোর ভ্রমণে আসা মানুষ কাঁচাগোল্লা নিয়ে যান। এ সময়ে তাদের বিকিকিনিও বাড়ে। বছরের অন্যান্য সময় নাটোরের মিষ্টির দোকানগুলো প্রতি মাসে ৩ থেকে ৪শ' মণ কাঁচাগোল্লা বিক্রি করে থাকে।

No comments

Powered by Blogger.