গোলটেবিল আলোচনায় সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতি : যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি নিজামুল হকের নিয়োগ বেআইনি

ন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিজামুল হকের নিয়োগ অবৈধ ও বেআইনি বলে উল্লেখ করে অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, সরকার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বর্তমানে যাদের গ্রেফতার করে বিচারের আয়োজন করেছে, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমও তাদের বিচারের দাবিতে একসময় আন্দোলন করেছেন। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূূল কমিটির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েটের মেম্বার ছিলেন তিনি।


এই কমিশনের তৈরি করা রিপোর্টের আলোকেই তদন্ত সংস্থা তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে এখন বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য পেশ করেছে। কাজেই যিনি তদন্ত করেছেন তিনিই আবার বিচার করছেন। এটা বেআইনি ও অবিচারের শামিল। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে দেশপ্রেমিক যুবশক্তি আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খন্দকার মাহবুব হোসেন বিচারপতি নিজামুল হককে উদ্দেশ করে এসব কথা বলেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে উদ্দেশ করে আরও বলেন, হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে একটি আচরণবিধি আপনাকে মেনে চলতে হবে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণতদন্ত কমিশনে জড়িত থাকায় নৈতিক অবস্থানের কারণে আপনার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে থাকার কোনো আইনগত অধিকার নেই। সরকার আপনাকে জোর করে এ পদে রাখতে চাইলেও আপনার পদত্যাগ করা উচিত। তিনি বলেন, আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার স্বার্থে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদ থেকে বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল : তদন্তে নিরপেক্ষতা ও বর্তমান প্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম, নব্বই’র গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা ও সর্বদলীয় ছাত্র আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুর রহমান খান আসাদ, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম দলের নেতা শাহজাদা মো. ওমর ফারুক প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংগঠনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান।
খন্দকার মাহবুব হোসেন অভিযোগ করেন, বিচারপতি নিজামুল হক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে তার কার্যক্রম অব্যাহত রেখে সুস্পষ্টভাবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, যখন বিচারকের নিরপেক্ষতা যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন বিচারকের উচিত নিজেকে সেই বিচারিক কার্যক্রম থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া। এই আচরণবিধি ও নৈতিকতা ভঙ্গ করে তিনি পদে বহাল থাকলে দায়দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে। বিধিতে আছে, বিচারক যখন নিজেই একজন সাক্ষী হন, তখন তাকে সেই বিচারিক কার্যক্রম থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। তিনি বলেন, বিচারপতি নিজামুল হকের ওপর অনাস্থা এনে একটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে, যার ওপর ১৩ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি, ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনি ওই শুনানিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েটের সদস্য ছিলেন, যে কমিশনের কাজ ছিল বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে দলিল-প্রমাণ সংগ্রহ ও গণতদন্ত কমিশনকে সহায়তা করা। এক্ষেত্রে বিচারপতি নিজামুল হক বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত কাজে সরাসরি জড়িত ছিলেন। অন্যদিকে গণতদন্ত কমিশন যে তদন্ত প্রতিবেদনটি বিচারপতি নিজামুল হকের সহায়তায় প্রস্তুত করেছে, তা ট্রাইব্যুনালে বাদী পক্ষের দলিল হিসেবে জমা দেয়া হয়েছে। যেহেতু বিচারপতি নিজামুল হক গণতদন্ত কমিশন ও গণ-আদালতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তাই তিনি বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলার বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না।
মাহবুব হোসেন বলেন, আমি এই ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বলে স্বীকার করি না। এ পর্যন্ত আমি ট্রাইব্যুনালে যাইনি। তবে আগামীতে হয়তো একবার হলেও সেখানে যেতে হবে। আমরাও চাই যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। অতীতেও এ ধরনের অনেক ট্রাইব্যুনাল হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রহসনের বিচারের জন্য গঠিত এসব ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের অনেককেই পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে হয়েছে। যারা আজকে বিচারের নামে প্রহসন করছে, দেশপ্রেমিক যুবশক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে তারা পালানোর পথ পাবে না। তারা জেগে উঠলে এর পরিণতি কী হবে, ভবিষ্যত্ই তা বলতে পারবে।
তিনি বলেন স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত ১৯৫ পাকিস্তানি সেনা সদস্যকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান দালাল আইন করে পরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। বিচার করতে হলে আগে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জনের বিচার করতে হবে। বিশ্বের কোনো দেশ আসল অপরাধীকে ক্ষমা করে সহযোগীদের বিচার সমর্থন করে না। আমাদের দেশের আইনেও প্রকৃত অপরাধীকে ছেড়ে সহযোগীর বিচারের বিধান নেই। ১৯৭৪ সালের সিমলা চুক্তির মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে ছেড়ে দিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। তাদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন সহযোগীদের নাম দিয়ে বিচার করা হচ্ছে। যারা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে।
নাজিমউদ্দিন আলম বলেন, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলো শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ক্যাঙ্গারু কোর্ট। এটা কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নয়। মনগড়া ট্রাইব্যুনাল দিয়ে সাজা দেয়াই এর লক্ষ্য। যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেই চান, তাহলে মুক্তিযুদ্ধকালে চিহ্নিত ১৯৫ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাকে ফেরত এনে বিচার করুন। মন্ত্রিসভায় থাকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, জামায়াতকে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের দল বলে লাভ নেই। জনগণ এ কথা বিশ্বাস করে না। অতীতে আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতের সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আন্দোলন করেছে তখন তারা যুদ্ধাপরাধী ছিল না। এখন বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক জোট গঠন করায় যুদ্ধাপরাধীদের দল হয়ে গেল। এসব কথা বলে জনগণকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.