দ্রুত তিস্তা চুক্তির আশ্বাস-হাসিনা-মনমোহন বৈঠক

ত দ্রুত সম্ভব তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মালদ্বীপের আড্ডু সিটিতে সপ্তদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে মনমোহন এ আশ্বাস দেন। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে সাংগ্রিলার ভিলিনগিলি রিসোর্টের ড. আলি রেস্টুরেন্টে দুই নেতার এ বৈঠক শুরু হয়। চলে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত। কূটনৈতিক সূত্রে এ খবর জানা গেছে।


বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির ইস্যুটি মনমোহনের কাছে খুব গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় দুই নেতার বৈঠকে যেসব চুক্তি ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, সেসবের বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়েও তারা আলোচনা করেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, যোগাযোগ, সীমান্ত নির্ধারণ, বাণিজ্য, ঋণ চুক্তির আওতাধীন প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি, বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতাসহ সামগ্রিক দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেন।
বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুটি নিয়ে ভারত কাজ করছে। যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন, ট্রানজিটসহ দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য ইস্যু নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন,
অভিন্ন সীমান্তের অবশিষ্ট অংশের স্ট্রিপ ম্যাপ দ্রুত স্বাক্ষর করার ওপর দুই নেতা জোর দিয়েছেন। বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি, অ্যাম্বাসাডার অ্যাট-লার্জ এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ ওয়াহিদ উজ্জামান, প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গত ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হাসিনা-মনমোহন বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে তা স্থগিত করা হয়। অন্যদিকে ট্রানজিটের সম্মতিপত্র স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশ।
তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের গণমাধ্যমও ব্যাপক সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
গত সপ্তাহে নয়াদিলি্লতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাই সাংবাদিকদের জানান, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় 'অমীমাংসিত থাকা' বিষয়গুলো নিয়ে মালদ্বীপে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হতে পারে। এর পর সোমবার গণভবনে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জানান, শুধু তিস্তা নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অভিন্ন ৫৩টি নদীর পানি বণ্টন নিয়েই আলোচনা হবে।
কানেকটিভিটি :বৈঠক সূত্র জানায়, আড্ডুতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শেখ হাসিনা ও ড. মনমোহন সিং জোর দিয়ে বলেছেন, আঞ্চলিক উন্নয়নে কানেকটিভিটি গুরুত্বপূর্ণ। কানেকটিভিটির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হলে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। পরীক্ষামূলক ট্রান্সশিপমেন্ট ইস্যু নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে শান্তিপূর্ণভাবে পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা ও সমাধানে উভয় দেশ কাজ করে যাবে বলে ঐকমত্য হয়। গত সেপ্টেম্বর থেকে কোনো ফি ছাড়াই পরীক্ষামূলকভাবে আশুগঞ্জ বন্দর হয়ে আগরতলা পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে ভারতকে সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, নতুন নির্ধারিত হারে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট ফি দিতে প্রস্তুত রয়েছে ভারত। বাংলাদেশ বলেছে, আগামী মার্চের মধ্যে ফি নির্ধারণ সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ হয়ে নেপালের ট্রানজিট কার্গো পরিবহনের জন্য রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ রেল রুট খুলে দেওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এতে তিনটি দেশই উপকৃত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আশা করছে, বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা এবং বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের ২০০ গজ ভেতরে ভুটান ও ভারতের ট্রাক প্রবেশের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) খুব শিগগির কার্যকর হবে। প্রধানমন্ত্রী আশা করেন, ভারতের সহায়তায় ফেনী নদীর উপর সেতু নির্মাণ, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ, আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শিগগিরই শুরু হবে।
সীমান্ত হাট :বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ-মিজোরাম-ত্রিপুরা সীমান্তে হাট ব্যবস্থা শুরুর ভারতীয় অনুরোধ সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কুড়িগ্রাম সীমান্ত হাট ভালোভাবে চলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বিভিন্ন ইস্যুতে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ভালো সম্পর্ক বিরাজ করছে। ভবিষ্যতে এ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে।
বিদ্যুৎ সহযোগিতা :টেকসই উন্নয়নে আঞ্চলিক বিদ্যুৎ সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে বলে দুই প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে একমত হয়েছেন। ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি বিষয়ে একটি ক্রয় চুক্তি শিগগির স্বাক্ষর হবে। ত্রিপুরার পালাটোনা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে আলোচনা শুরু করবে দুই দেশ। ভারত পালাটোনা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরঞ্জাম বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ইতিমধ্যেই নিয়ে গেছে।
ঋণ চুক্তি :এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির আওতায় গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করার প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন ড. মনমোহন সিং। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে নয়াদিলি্লতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয় ভারত। একই বছরের আগস্টে ঢাকায় ঋণ চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তির আওতায় এখন পর্যন্ত ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিভিন্ন প্রকল্প গৃহীত হয়েছে।
স্থল সীমান্ত চুক্তি :আড্ডুতে মনমোহনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করার ওপর জোর দিয়েছে বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বরে মনমোহনের ঢাকা সফরকালে স্থল সীমান্ত চুক্তির আওতায় একটি প্রটোকল স্বাক্ষর হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি কার্যকর হয়নি। চুক্তিটি সংসদে রেটিফাইও হয়নি। বৈঠকে ভারতীয় পক্ষ বলেছে, চুক্তিটি রেটিফাই করার জন্য তারা কাজ শুরু করেছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ চুক্তিটি রেটিফাই করলেও ভারত এখনও রেটিফাই করেনি।

No comments

Powered by Blogger.