মরুতে গাদ্দাফির শেষ শয্যা-গোপনে দাফন

তকাল মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে লিবিয়ার সাবেক স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে অজ্ঞাত স্থানে দাফন করা হয়েছে। রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ২১৫ কিলোমিটার দূরে মিসরাতা শহরের উপকণ্ঠে ঊষর মরুভূমির কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে গাদ্দাফি, তার ছেলে মুতাসিম এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু বকর ইউনুস জাবেরের লাশ একই সঙ্গে দাফন করা হয়। ইসলামী ধর্মীয় অনুশাসন মোতাবেক জানাজাও অনুষ্ঠিত হয়। মৃতদের স্বল্পসংখ্যক আত্মীয় ও সরকারি কর্মকর্তা দাফন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। দাফনের সময় সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাবা এবং তার দুই ছেলে উপস্থিত ছিলেন।


মিসরাতা বাজারের নৈশপ্রহরী বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, সোমবার গভীর রাতে চার থেকে পাঁচটি সামরিক যানে করে মৃতদেহগুলো অজ্ঞাত স্থানের উদ্দেশে নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার নিহত হওয়ার পাঁচ দিন পর গাদ্দাফি এবং তার ছেলেকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে দাফন করা হয়েছে। এনটিসির মুখপাত্র ইব্রাহিম বেইতালমাল বলেন, লিবিয়ার সাবেক শাসক এবং তার ছেলের কবরস্থান যেন ধ্বংসোন্মাদনার শিকার না হয় এ জন্য গোপনীয়তার কৌশল নেওয়া
হয়েছে। গাদ্দাফি শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তাকে এবং তার সঙ্গে নিহতদের যেন তার জন্মস্থান সিরতে শহরে স্বজনদের পাশে দাফন করা হয়। কিন্তু
লিবিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার গাদ্দাফির শেষ ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়নি।
বৃহস্পতিবার সিরতে শহরে এনটিসি যোদ্ধাদের হাতে নিহত হওয়ার পর গাদ্দাফি এবং তার ছেলে মুতাসিমের লাশ মিসরাতা শহরে নেওয়া হয়। সেখানে একটি বাজারে মাংস রাখার হিমঘরে পিতা-পুত্রকে কম্বলে মুড়িয়ে রাখা হয়েছিল। রোববার পর্যন্ত স্থানটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। গাদ্দাফির লাশ দাফন নিয়ে অন্তর্বর্তী কাউন্সিল নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এভাবে অনিশ্চয়তায় কেটে যায় পাঁচটি দিন। লাশে পচন ধরায় সোমবার ভোররাতে সামরিক গাড়িতে করে তিনটি লাশ অজ্ঞাত স্থানের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। এনটিসির সামরিক বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, গাদ্দাফির অনুগত তিন আলেম জানাজা পরিচালনা করেন। গাদ্দাফির পরিবারের দাবি ছিল, গাদ্দাফি এবং মুতাসিমের লাশ যেন তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এনটিসি শুরুতে বলেছিল, গাদ্দাফির লাশ হস্তান্তরের ব্যাপারে তার পরিবারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কিন্তু পরে কয়েক দফা বৈঠকের পর এনটিসি উলি্লখিত তিনজনের লাশ অত্যন্ত গোপনে দাফন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এনটিসি মনে করছিল, গাদ্দাফিকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী দাফন করা হলে অদূর ভবিষ্যতে স্থানটি স্মৃতিসৌধ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে কিংবা গাদ্দাফিবিরোধীদের হামলা বা ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হতে পারে। উভয় আশঙ্কা থেকে শেষ পর্যন্ত লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার কোনো ঊষর মরুভূমির অজ্ঞাত স্থানে এক সময়ের প্রচণ্ড প্রতাপশালী শাসককে শেষনিদ্রায় শুইয়ে দেওয়া হয়। গাদ্দাফি, তার ছেলে মুতাসিম এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু বকরকে এনটিসির যোদ্ধারা সিরতে শহরে আটক করার পর গুলি করে হত্যা করে।
আলজাজিরা সংবাদদাতা হোদা হামিদ গতকাল বলেছেন, গাদ্দাফির উপজাতীয় স্বজনরা তাদের কাছে গাদ্দাফির লাশ হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছিল অন্তর্বর্তী কাউন্সিলের কাছে। কিন্তু এনটিসি তাদের সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে এনটিসির মুখপাত্র জানিয়েছেন, গাদ্দাফির দাফন অনুষ্ঠানে তার স্বগোত্রের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। হোদা হামিদ আরও বলেন, ফ্রিজে রাখা সত্ত্বেও গাদ্দাফি এবং তার ছেলের লাশের পচন রোধ বা শ্লথ করা সম্ভব হয়নি। কেননা দর্শকদের জন্য হিমঘরের দরজা সব সময় উন্মুক্ত রাখা হতো। এনটিসির পক্ষ থেকে গাদ্দাফির দাফন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিস্তারিত কোনো তথ্য জানানো হয়নি। পুরো বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে করা এবং তা গোপনে রাখার জন্য এনটিসি এ বিষয়ে খুব সামান্যই মুখ খুলেছে।
বিবিসি জানায়, এনটিসির সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দাফন সম্পন্ন করা বিলম্বিত হয়। কেননা তারা (এনটিসি) সিদ্ধান্তে আসতে পারছিল না কখন, কোথায় এবং কীভাবে গাদ্দাফি এবং তার ছেলের লাশ দাফন করা যায়। গত সোমবার থেকে এনটিসির নেতৃবৃন্দ ধারণা দেন যে, লাশ গোপনে দাফন করা হবে। তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে না।
লিবিয়ার তথ্যমন্ত্রী মাহমুদ শাম্মাম বলেন, গাদ্দাফির কবর জনগণকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে এমন সম্ভাবনা থেকে তার দাফন কোনো স্থায়ী কবরস্থানে করা হয়নি।
এনটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, লাশে পচন শুরু হওয়ায় তার সংরক্ষণ করা আর সম্ভব হয়নি। তবে গাদ্দাফি, তার ছেলে এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাফন খুব সাধারণভাবে অনুষ্ঠিত হবে এবং তা হবে উন্মুক্ত মরুভূমিতে, অজ্ঞাত স্থানে। হিমঘরের প্রহরী সালেম আল মোহান্দেস আলজাজিরা টিভিকে বলেন, লাশের সঙ্গে আমিও ছিলাম। তাদের কোথায় নেওয়া হয়েছে তা আমি বলতে পারব না। তবে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে...। ত্রিপোলি থেকে বিবিসির সংবাদদাতা কাতেয়া অ্যাডলার বলেন, গাদ্দাফির দাফনের বিষয়টি কোনো একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হবে এবং কেনইবা এ কাজটি শেষ করতে ৪ দিন সময় লাগল? এ প্রশ্ন এখন সবার মনেই। কেননা ইসলামিক রীতি মোতাবেক মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাফন কাজ শেষ করতে হবে। এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা আটক করার পরেও গাদ্দাফিকে হত্যা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছে। একই সঙ্গে সিরতের একটি হোটেলে ৫৩ জন গাদ্দাফি অনুগত যোদ্ধাকে হত্যারও তদন্ত দাবি করেছে।

No comments

Powered by Blogger.