জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ১০০ বছরের পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার by আবুল কাশেম

৯৯৮ সালের বন্যায় দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ এলাকা ডুবে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় জিডিপির ৪.৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, টাকার অঙ্কে ওই বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ২০০ কোটি ডলার। ২০০৭-এর ঘূর্ণিঝড় সিডরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় জিডিপির ২.৬ শতাংশ বা ১৭০ কোটি ডলার। জলবায়ু পরিবর্তনের এসব ক্ষতিকর দিক মোকাবিলাসহ সুষ্ঠু পানি ও কৃষি ব্যবস্থাপনা এবং জানমাল রক্ষায় নেদারল্যান্ডসের আদলে 'বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০' নামের ৫০ থেকে ১০০ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছে সরকার। বিভিন্ন সময়ে নেওয়া নানা কর্মসূচি ও পরিকল্পনাকে একই ছাতার আওতায় এনে এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে।


পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ (জেইডি) টেকসই উন্নয়নের জন্য এ পরিকল্পনা তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে। পরিকল্পনাটিকে 'বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০' নামেও উল্লেখ করা হচ্ছে।
জেইডি বলছে, এটি হবে পুরো জাতির কৌশলগত পরিকল্পনার পথপ্রদর্শক। এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে এর হিসাব না কষলেও জেইডি বলছে, এ পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের অর্থ সরকারের রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (জেইডি) ড. শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষি উন্নয়ন, ভূমি ব্যবহারসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে এর কোনোটিই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলার পাশাপাশি পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষি খাতের বিকাশ, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ৫০ থেকে ১০০ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে জেইডিকে অনুরোধ করা হয়েছে। তাই ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে জেইডি। তিনি জানান, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ ধরনের ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করেছে। ১৯৫৪ সালে নেদারল্যান্ডস এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার পর দেশটিতে কখনো বন্যা হয়নি। টেকসই উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। দেশটিও প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসছে।
জেইডির কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের জন্য আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে জানমাল রক্ষা করা। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে সৃষ্ট বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচিতে অগ্রগতি হচ্ছে সামান্য। জাতীয় উন্নয়ন ও জানমালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সরকার বিভিন্ন সময় নানা কর্মসূচি ও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এ অবস্থায় বিদ্যমান সব পরিকল্পনাকে একই ছাতার আওতায় এনে ডেল্টা প্ল্যান চূড়ান্ত করা হবে।
ডেল্টা প্ল্যান নিয়ে জেইডির তৈরি করা ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি একীভূত করে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এতে ২১০০ সালে বাংলাদেশ কেমন হবে_এর একটি রূপরেখাও পাওয়া যাবে। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক মিল রয়েছে। তারাও বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মধ্যে ছিল। কিন্তু দেশটি 'নেদারল্যান্ডস ডেল্টা প্ল্যান-২১০০' বাস্তবায়ন করার পর পানি ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু হয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষা পাচ্ছে। জেইডির কর্মকর্তারা জানান, নেদারল্যান্ডসের অভিজ্ঞতা সপ্তাহব্যাপী সরেজমিনে দেখতে ড. শামসুল আলম আগামী ২৯ অক্টোবর দেশটিতে যাচ্ছেন।
ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন শুরু হবে স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি দিয়ে। এর মধ্যে থাকবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ভিশন-২০২১, দক্ষিণাঞ্চলের জন্য কৃষির মাস্টার প্ল্যান, হাওর মাস্টার প্ল্যান। ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, এ ধরনের সমন্বিত ডেল্টা প্ল্যান ছাড়া টেকসই উন্নয়ন ও জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এখন যেভাবে খাতভিত্তিক স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব বাংলাদেশের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ছাড়া দেশের সীমিত প্রাকৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পদ নিয়ে ভবিষ্যতে আরো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার মধ্য দিয়েই স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।
জেইডি সদস্য শামসুল আলম আরো জানান, ইতিমধ্যে ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়নের প্রস্তুতি হিসেবে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে দুই দফা বৈঠক হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করছে জেইডি। এই কর্মশালায় পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত আলফন্স হেনেকেন্স, কৃষিসচিব মোস্তাক আহমেদ, বন ও পরিবেশসচিব মেজবাহ উল আলম, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ভুঁইয়া শফিকুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সুপারিশ ও পরামর্শ নেওয়া হবে। আগামী ডিসেম্বরে উচ্চপর্যায়ের আরেকটি বৈঠকের পর ২০১২ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে এ পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক হবে। সেখানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়নে 'ডাচ-বাংলা সহযোগিতা'বিষয়ক একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.