গাদ্দাফির শেষ নিদ্রা অজ্ঞাত মরুভূমির কোলে

রুর অবিসংবাদিত বাদশাহর শেষশয্যা হলো মরুর কোলেই। মরুদিগন্তে তখনও ওঠেনি ভোরের সূর্য। চারপাশে নিঝুম নীরবতা। ঠিক এমনই পরিবেশে গতকাল লিবিয়ার অজ্ঞাত মরুভূমিতে চরম গোপনীয়তায় দাফন করা হয়েছে এই দেশটির সাবেক লৌহশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি, তার ছেলে মুতাসসিম এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু বকর ইউসুফকে।লিবিয়ার জাতীয় অন্তর্বর্তী সরকার বা এনটিসির একজন কর্মকর্তা এ খবর জানিয়েছেন।


এর মাধ্যমে গাদ্দাফির মরদেহ কীভাবে ও কোথায় দাফন করা হবে, তা নিয়ে গত ক’দিন ধরে চলে আসা কৌতূহলের অবসান হলো। কর্নেল গাদ্দাফির পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছিলেন, তার মরদেহ যেন তার জন্মস্থান সির্তের বাইরে দাফন না করা হয়। সে আবেদন রক্ষা করা হয়েছে বলে এনটিসির পক্ষ থেকে আভাস দেয়া হয়েছে। বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, আলজাজিরা, এপি, সিএনএন
মিসরাতায় লিবিয়ার এক সেনাকর্মকর্তা একটি বার্তা সংস্থাকে জানান, গতকাল ভোর পাঁচটায় গাদ্দাফিকে সমাহিত করা হয়েছে। এর আগে গাদ্দাফির জানাজা আদায় করা হয় এবং এতে তার গোত্রের কয়েকজন নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা অংশ নেন। তবে একটি সূত্র বলেছে, গতরাতেই তার জানাজা পড়া হয়েছিল।
এর আগে এনটিসির এক কর্মকর্তা আলজাজিরা নিউজ চ্যানেলকে বলেছিলেন, গাদ্দাফির মরদেহ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দাফন করা হবে। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, গাদ্দাফির মৃতদেহে পচন ধরার কারণে তা দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতরাতেই গাদ্দাফি, তার ছেলে ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মৃতদেহ মিসরাতার হিমাগার থেকে বের করা হয়। লাশগুলো দর্শনার্থীদের দেখানোর জন্য মাংস রাখার ওই হিমাগারে রাখা হয়েছিল। মৃতদেহ এখান থেকে গাড়িতে ওঠানোর আগেই জানাজা আদায় করা হয় বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
গাদ্দাফির মৃতদেহ প্রকাশ্যে সমাহিত করা হলে সেখানে তার অনুসারীরা মাজার নির্মাণ করতে পারে বলে এনটিসির আশঙ্কা। এছাড়া গাদ্দাফির শাসনামলে চরম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যরা ধিক্কার জানানোর জন্য তার সমাধিস্থলে সমবেত হতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতারা। এসব কারণে লিবিয়ার সাবেক নেতার মৃতদেহ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন তারা। তবে শেষপর্যন্ত অজ্ঞাত স্থানে দাফনের মাধ্যমে এ নিয়ে আশঙ্কা আপাতত কেটে গেল বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
এদিকে এনটিসি প্রধান মুস্তাফা আবদুল জলিল বলেছেন, গাদ্দাফির মৃত্যুকে ঘিরে যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তা অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। গাদ্দাফি জীবিত অবস্থায় এনটিসির যোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন বলে ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হওয়ার পর তার মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকর্তারা বলেছেন, ক্রসফায়ারে পড়ে গাদ্দাফির মৃত্যু হয়েছে।
৬৯ বছর বয়সী গাদ্দাফির মরদেহের পোস্টমর্টেম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাথায় বুলেটবিদ্ধ হয়ে তিনি নিহত হয়েছেন।
দীর্ঘ নয় মাসের লড়াইয়ে একে একে সব অঞ্চল থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাদ্দাফি ও তার অনুগত বাহিনী গিয়ে আশ্রয় নেন সির্তে। এই শহরটি গাদ্দাফির জন্মশহর এবং শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
শেষপর্যন্ত গত বৃহস্পতিবার সেখান থেকে পালানোর সময় গাদ্দাফি এনটিসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং বেধড়ক পিটুনি ও গুলিতে নিহত হন। তার এক ছেলে মুতাসসিমও ওই সময় নিহত হন।
এনটিসি চায়নি গাদ্দাফিকে ঘিরে সমাধি হোক
অনেক নাটকীয়তার পর গতকাল লিবিয়ার কোনো এক মরুভূমির অজ্ঞাত ঠিকানায় দেশটির সাবেক নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও তার ছেলে মুতাসসিমকে দাফন করা হয়েছে। কিন্তু গাদ্দাফির লাশ দাফন নিয়ে দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের গোপনীয়তার অন্ত ছিল না। এই গোপনীয়তা সম্পর্কে কয়েকদিন আগে এনটিসির এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন, গাদ্দাফির দাফনের সময় মাত্র চারজন প্রত্যক্ষদর্শী থাকবে। দাফনের স্থানের নাম প্রকাশ না করার ব্যাপারে এই প্রত্যক্ষদর্শীরা কোরআন ছুঁয়ে শপথ করবেন।
গাদ্দাফির মরদেহ নিয়ে দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের ভীতির কারণ অনুসন্ধান করছেন লিবিয়ার মিসরাতায় অবস্থানরত আলজাজিরা টেলিভিশনের প্রতিনিধি হোদা হামিদ। এ প্রসঙ্গে হোদা হামিদ বলেন, এনটিসি চায়নি গাদ্দাফিকে ঘিরে সমাধি গড়ে উঠুক। এ কারণে দাফনের আগে গাদ্দাফির মরদেহের জন্য গোত্রের লোকজনের দোয়া অনুষ্ঠান অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এরপর এনটিসির কমান্ডাররা মরুভূমির এক অজ্ঞাত স্থানে তার মরদেহ নিয়ে যান এবং তা সমাহিত করেন।
গত বৃহস্পতিবার লিবিয়ার সাবেক নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি এনটিসির সেনাদের হাতে জীবিত ধরা পড়েন। পরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
পাঁচদিন ধরে মিসরাতা শহরের কাঁচাবাজারের একটি হিমঘরে তার লাশ পড়ে ছিল। এমনকি গাদ্দাফির লাশে পচনও ধরে। এনটিসির এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘মরদেহের এমন অবস্থা হয়েছে যে, তা আর রাখা সম্ভব নয়।’
এর আগে গাদ্দাফির পরিবার তার মরদেহ তাদের স্থানীয় স্বজনের কাছে হস্তান্তর করার দাবি জানায়। কিন্তু এ নিয়ে এনটিসি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। অবশেষে কর্তৃপক্ষ গাদ্দাফি ও তার ছেলে মুতাসসিমের মরদেহ গোপনেই দাফন করল।
একই ধরনের ভীতির কারণে মার্কিন প্রশাসনও আল কায়দার সাবেক প্রধান ওসামা বিন লাদেনের মরদেহ সমুদ্রে সমাহিত করেছিল।

No comments

Powered by Blogger.