প্রখ্যাত ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদার আর নেই

নসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে যিনি নিখুঁতভাবে তার ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন প্রখ্যাত সেই প্রেস ফটোগ্রাফার রশীদ তালুকদার আর নেই। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। আঘাতজনিত কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষণের ফলে তিন মাস ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। তিন মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে বড় মেয়ের কাছে বেড়াতে গিয়ে বাথরুমে পড়ে আঘাত পান। তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো ইনজুরি অনুভব না করায় এর পরপরই দেশে ফিরে আসেন তিনি। চিকিত্সকরা বলেছেন, ওই অবস্থায় দীর্ঘ বিমান ভ্রমণে তার মস্তিষ্কে বড় ধরনের ক্ষতি হয়।


মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়েসহ বহু আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।ঢাকার রাস্তায় মিছিলের সামনে তার তোলা একটি শিশুর মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রতীক হয়ে আছে। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে গত বছর আন্তর্জাতিক পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন রশীদ তালুকদার। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গণহত্যার প্রচুর ছবি ক্যামেরাবন্দি করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির ঘুরে ঘুরে তিনি বহু ছবি তুলেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদারের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ দেশের গণমাধ্যম অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা ছুটে যান স্কয়ার হাসপাতালে। সেখানে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্থায়ী সদস্য রশীদ তালুকদারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আজ সকাল সাড়ে ১১টায় লাশ আনা হবে তার সেকেন্ড হোম হিসেবে পরিচিত জাতীয় প্রেস ক্লাবে। দুপুর ১২টায় প্রেস ক্লাব চত্বরে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে তার বাসাবোর বাসভবন সংলগ্ন স্থানীয় মসজিদে জানাজা হবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও তার লাশ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা হবে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদারের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেছেন। শোক জানিয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
রাষ্ট্রপতি তার শোকবার্তায় বলেন, ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদার দেশের আলোকচিত্র সাংবাদিকতার একজন পথিকৃত্। তিনি একজন প্রকৃত পেশাদার ফটোসাংবাদিকই নন, তার তোলা বহু রাজনীতিক ও ঐতিহাসিক ছবি স্মরণীয় হয়ে আছে। দেশ এমন একজন সৃজনশীল ফটোসাংবাদিককে হারাল, যার অভাব পূরণ হওয়ার নয়।
জার্মান সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এক শোকবার্তায় তার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে বলেছেন, রশীদ তালুকদার ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা ফটোসাংবাদিক। প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কথা স্মরণ করেন।
বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তার শোকবার্তায় বলেন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার আলোকচিত্র মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। বিরোধীদলীয় নেতাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও পৃথক শোকবাণীতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন। একই সঙ্গে তারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। রশীদ তালুকদারের মৃত্যুর খবর শুনে গতকাল তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ ক্লাবের স্থায়ী সদস্য ও প্রবীণ ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদারের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোক বিবৃতিতে তারা বলেন, রশীদ তালুকদার ছিলেন একজন সৃজনশীল ফটোসাংবাদিক। তার মৃত্যুর ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। তারা মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী রশীদ তালুকদারের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ অক্টোবর ভারতের চব্বিশপরগণায়। তার বাবার নাম আবদুল করিম তালুকদার ও মায়ের নাম রহিমা খাতুন। ১৯৬২ সালে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি ২৯ বছর কাজ করেছেন। ৪৭ বছর ধরে তিনি ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে তিনি গত বছর আন্তর্জাতিক ‘পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন।
রশিদ তালুকদারের ছবিতে পাওয়া যায় জীবনের কথা, সমস্যার কথা, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং জনসাধারণের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিদর্শন। তার ছবিতে বিষয়বস্তুর যে বিচিত্র সমাহার—তা আর অন্য কোনো আলোকচিত্র শিল্পীর ছবিতে তেমন দেখা যায় না। তার বিখ্যাত, বহুল প্রচারিত ও মুদ্রিত এমন কিছু ছবি রয়েছে—যা ইতিহাসের সত্যতাকে ধারণ করছে যুগ যুগ ধরে। তার এমনই একটি আলোকচিত্র, যা সময় এবং কালকে অতিক্রম করে বার বার ইতিহাসকে নাড়া দেয়, আমাদের অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় মিছিলে স্লোগানরত নিহত টোকাইয়ের ছবিটি। গণঅভ্যুত্থানের শেষ মিছিল ছিল এটি। আইয়ু্ব খানের ছবিতে জুতার মালা পরিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ওই মিছিলটি যখন শিক্ষা ভবন মোড়ে এসে পৌঁছে, তখন রশীদ তালুকদারের চোখ আটকে যায় ওই শীর্ণ টোকাইয়ের ওপর। টোকাইটির চোখ ও মুখের প্রতিবাদী ভাষা সারাদেশের নিপীড়নের কথা মনে করিয়ে দেয়, অন্যকে প্রতিবাদ করতে আহ্বান জানায় এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ডাক দেয়। তাই দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করে তিনি পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়াতেই শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ইপিআর কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হয়ে ছেলেটি নিহত হয়। কিন্তু রশীদ তালুকদারের ক্যামেরার ফ্রেমে সে সময়ের নির্ভীক ও সাহসী প্রতিবাদ জীবন্ত হয়ে আছে, থাকবে।
উল্লিখিত ছবিটি ছাড়া ঊনসত্তর সালের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সত্তর সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ফলাফল, অসহযোগ আন্দোলন, একাত্তরের যুদ্ধ, যুদ্ধ-পরবর্তী হাহাকার, আহাজারি, কান্না, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানবিক অনুভূতি, নারী আন্দোলন, বিভিন্ন সংগ্রাম প্রভৃতি বিষয়বস্তু তিনি তার ক্যামেরার মাধ্যমে মানুষের সামনে আবেদনময় করে উপস্থাপন করেছেন—মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে জাগ্রত করে তুলেছেন। সেই সঙ্গে তার আলোকচিত্র ইতিহাসের সাক্ষী তথা প্রমাণিত দলিল হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।
তার কাজের মূল্যায়ন হিসেবে তিনি সর্বমোট ৭২টি সংবর্ধনা পেয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সোসাইটি ও সংস্থা কর্তৃক, জাপান, ইউনেস্কো, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ থেকে একাধিকবার পুরস্কার লাভ করেছেন। ফ্রান্সে জাতিসংঘ আয়োজিত ‘নিরাশ্রয়ের জন্য আশ্রয়’ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় একসঙ্গে ৬টি পুরস্কার অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে মুসলিম ওয়ার্ল্ড শীর্ষক প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান, জার্মান ডিডিআর থেকে ডিপ্লোমা, জাপান ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও আসহাই সিমবুন পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পরপর দুবার পুরস্কৃত হন। এছাড়া পূরবী পদক-৯৩, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী-৯০ অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে বিজ্ঞান জাদুঘর, ১৯৮২ সালে বিপিএস তাকে স্বর্ণপদক প্রদান করে। জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক দু’বার বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় একাধিকবার পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর রশীদ তালুকদারের কৃতিত্বের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রশংসাপত্র পাঠান। এছাড়া তিনি উল্লেখযোগ্য অনেক সম্মাননা অর্জন করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.