মার্কেল-হাসিনা দ্বিপক্ষীয় বৈঠক-জলবায়ু ও স্বাস্থ্য বিষয়ে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত

বাংলাদেশ ও জার্মানির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির আরো নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করার বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে।দুই দেশ বর্তমান চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন মাত্রাদান এবং উভয় দেশের জনগণের অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করতেও সম্মত হয়।গতকাল মঙ্গলবার জার্মান চ্যান্সেলরের সরকারি বাসভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চ্যান্সেলর ড. এঙ্গেলা মার্কেলের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ মতৈক্য হয়।


বাসস জানায়, দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ড. অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেন, তাঁরা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং অভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুর ব্যাপারে খুবই খোলামেলা, বিস্তারিত ও ফলপ্রসূ আলোচনা করেছেন।
বৈঠকে অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জার্মানির চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে এবং দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'জার্মান নেতার কাছ থেকে বহু প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি।'
বিডিনিউজ জানিয়েছে, স্বাধীনতার পর ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও দীর্ঘদিন সেনাশাসনে থাকায় বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি উল্লেখ করে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, আগামীতে বাংলাদেশ 'ভালোর দিকে' যাবে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন।
গতকাল বার্লিনের চ্যান্সেলারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জার্মান নেতা বলেন, তাঁর দেশ বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতা দিয়ে যাবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, 'পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে জার্মানি অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। আমরা আশা করছি, এ খাতে তারা আরো সহযোগিতা দেবে।'
গতকাল স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার দিকে শেখ হাসিনা চ্যান্সেলারিতে পেঁৗছালে মার্কেল তাঁকে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রী জার্মান চ্যান্সেলরের সঙ্গে তাঁর সফরসঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দেন।
জার্মান চ্যান্সেলরের কার্যালয়ে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয় এবং একদল চৌকস সেনাসদস্য প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেন। এরপর প্রায় একঘণ্টা বৈঠক ও ভোজসভায় অংশ নেন দুই নেতা। বৈঠকে জার্মান চ্যান্সেলরকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ বৈঠকের আগে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতার বিষয়ে যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও জার্মানি সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে গতকাল বার্লিনের অ্যাডলন কেমপিনস্কি হোটেলে এ-সংক্রান্ত দুটি সম্মতিপত্র (জয়েন্ট ডিক্লারেশন অব ইনটেন্ড) স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে 'জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও প্রশমন' শিরোনামের যৌথ ঘোষণাটিতে স্বাক্ষর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মণি এবং জার্মানির পক্ষে দেশটির অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নমন্ত্রী ডির্ক নিয়েবল। এই সম্মতিপত্র অনুযায়ী বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জার্মানি এক কোটি ৯০ লাখ ইউরো সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছে। এরপর স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে 'স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতা' শিরোনামে আরেকটি সম্মতিপত্রে সই করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক এবং জার্মানির পার্লামেন্টারি স্টেট সেক্রেটারি এনিত্তি ওয়াইডম্যান।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ ওয়াহিদ উজ জামান, প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশে জার্মান রাষ্ট্রদূত হোলগার মাইকেল এবং জার্মান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
গতকাল জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুইডো ভেস্টভেলও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর হোটেল স্যুটে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে তাঁরা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের জানান, তাঁরা এ সময় অব্যাহত বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জি-৮ভুক্ত দেশগুলোর বাজারে স্বল্পোন্নত দেশের পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার অর্জনে জার্মান সরকারের সমর্থনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এর আগে একই হোটেলে জার্মানির পরিবেশমন্ত্রী নরবার্ট রোট্টজেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জার্মানির সহায়তা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, জার্মানিতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংস্থা (আইআরইএনএ) জার্মানির সাশ্রয়ী ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ জার্মানির উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পরিবেশবান্ধব প্রকৌশল ও প্রযুক্তির সুবিধা চায়, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের এ ধরনের প্রযুক্তির প্রয়োজন।'
এ ছাড়া বাংলাদেশ-জার্মান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিজিসিসিআই) এক প্রতিনিধিদল গতকাল সন্ধ্যায় বার্লিনের এডলো কেমপিনস্কি হোটেল লাউঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি একই ধরনের আহ্বান জানান। বিজিসিসিআইর সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম ১৭ সদস্যের এ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
এর আগে গত সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জার্মান পার্লামেন্ট বুদেসটাগ প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. নরবাট লেমার্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে ড. লেমার্ট শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।
শেখ হাসিনার উদ্দেশে ড. লেমার্ট বলেন, 'নিজের দেশের মতোই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণের মাঝেও আপনি সমান জনপ্রিয়।'
শেখ হাসিনা বুদেসটাগ প্রেসিডেন্টকে জানান, ২০০৯ সালে ভোটগ্রহণের পর তাঁর সরকার পার্লামেন্ট অধিবেশনের শুরুতেই ৪৮টি স্থায়ী কমিটি গঠন করে এবং কিছু কমিটির সভাপতির দায়িত্ব বিরোধী দলকেও দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকৃত ও টেকসই গণতন্ত্রের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অপরিহার্য উল্লেখ করে বলেছেন, তাঁর সরকার জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে বিশেষ করে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করছে।
প্রধানমন্ত্রী গত সোমবার রাতে জার্মানির রিজেন্ট হোটেলে জার্মান-সাউথ এশিয়া পার্লামেন্টারি গ্রুপ (জিএসএপিজি) আয়োজিত এক নৈশভোজ সভায় ভাষণে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে এসব কথা বলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে যোগ দিতে গত শনিবার বার্লিনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফর শেষে বার্লিন সময় বিকেল ৫টার দিকে টিগেল বিমানবন্দর থেকে দেশের উদ্দেশে রওনা হন প্রধানমন্ত্রী। দুবাইয়ে যাত্রাবিরতির পর আজ বুধবার প্রধানমন্ত্রীর দেশে পেঁৗছানোর কথা।

No comments

Powered by Blogger.