সরকারের ব্যাংক ঋণ-১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে by ওবায়দুল্লাহ রনি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতার পরও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নিচ্ছে সরকার। গত ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। এতে করে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে এ খাতে সরকারের ঋণ ছিল ঋণাত্মক (-) ২২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল তার চেয়ে ২২০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছিল। আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়া, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমা, আশানুরূপ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান না আসাসহ নানা কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ব্যয় মেটাতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, সরকারের এসব ঋণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে ৪ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ১২ মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। এতে করে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত নেওয়া এসব ঋণের দৈনিক গড় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে পর্যাপ্ত তারল্য না থাকায় তারা সরকারকে চাহিদা অনুপাতে ঋণ সরবরাহ করতে পারছে না। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই ঋণ সরবরাহ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণত নতুন নোট ইস্যু করে টাকা সরবরাহ করে থাকে। যা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ কমে যায়। এতে উৎপাদনশীল খাত বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য উন্নত আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বৈদেশিক সাহায্য ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় সরকারের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। যে কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে সরকারের দৈনন্দিন অনেক কাজ চালাতে হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের অতিরিক্ত ঋণের ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে তার ধারণা। ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সাহায্য বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণ নিয়ে সতর্ক করা হয়। ব্যাংকিং খাত থেকে বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণগ্রহণ সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে বলে সেখানে বলা হয়। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্যতা কমে যায়। এছাড়া সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ মানে নতুন নোট ইস্যু যা বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (গত বছরের একই সময়ের তুলনায়) মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। যা গত দেড় দশকের সর্বোচ্চ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা সমকালকে জানান, রাজস্ব আদায় কম থাকায় এ মুহূর্তে সরকার তার প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে বেশি বেশি ধার করছে। ব্যাংকের বাইরে অন্যান্য উৎস সঞ্চয়পত্র এবং বৈদেশিক উৎস থেকে তুলনামূলকভাবে কম ঋণ পাওয়ায় সরকার ব্যাংক ঋণের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভর হয়ে গেছে। সরকার একটু বেশি ঋণ নিলেও মুদ্রা সরবরাহ কিংবা অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি যাতে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে থাকে সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সূত্র জানিয়েছে, ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে ১৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ঋণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। পরে তা বাড়িয়ে ১৮ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা করা হয়। ওই লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে অর্থবছর শেষে নিট ঋণ দাঁড়ায় ২০ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছর নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ঋণাত্বক (-) ৭ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল তার তুলনায় ওই পরিমাণ বেশি পরিশোধ করা হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.