আলোচনা- 'কর্মপরিবেশঃ স্বর্গে তৈরি' by এ জেড এম সাইফুদ্দীন

ভোগবাদ আজ পৃথিবীজুড়ে সব ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু। আর সঙ্গে সঙ্গে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কোন পরিবেশে পণ্য তৈরি হচ্ছে, এ ব্যাপারেও ভোক্তারা আজ অনেক বেশি সচেতন। জার্মানির একটি এনজিও তাদের ‘ক্লিন ক্লোথস ক্যাম্পেইন’ শীর্ষক প্রচারণার অংশ হিসেবে বেশ কিছু দোকানের সামনে ‘মেইড ইন হেল’ বা ‘নরকে তৈরি’ লেখা সাইন নিয়ে নিম্নমানের উৎপাদন পরিবেশের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কয়েক বছর আগে, যুক্তরাজ্যের একটি শীর্ষস্থানীয় খবরের কাগজ প্রকাশ করে যে যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু বিখ্যাত ব্র্যান্ড তাদের পণ্য তৈরি করে কম্বোডিয়ার একটি কারখানায়।
যে কারখানাটি এর আগে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন কর্তৃক পরিদর্শনপূর্বক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সবচেয়ে নিম্নমানের হিসেবে স্বীকৃত হয়। আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে ‘মানুষ বা ভোক্তা-পৃথিবী-মুনাফা’ এই দর্শন সর্বজনবিদিত। আমরা সবাই জানি যে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) মানে হলো একটি সমাজ ও পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা; অবশ্যই সেটা কোম্পানির সামগ্রিক মুনাফাকে অক্ষুণ্ন রেখে। এবং বিশ্বায়নের ফলে সিএসআরের এই দর্শন বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। সিএসআর বিশ্বব্যাপী ব্যবসায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে করে কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসাপ্রণালির মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে সমাজ ও পরিবেশে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে কাজ করে। কারণ, কোনো ব্যবসাই সমাজ ও পরিবেশকে বাদ দিয়ে নয়। একাধিক সমমনা প্রতিষ্ঠান, সুশীল সামাজিক সংগঠন (যেমন এনজিও) এবং সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণ একটি সিএসআরকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাফল্য এনে দিতে পারে। তাই এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে মানসম্পন্ন এবং কার্যকর সিএসআর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে একাধিক অংশীদারির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। বেশ কিছু এনজিও কোম্পানির কর্মপরিবেশ নিয়ে কাজ করছে, আবার কেউ কাজ করছে মানবাধিকার নিয়ে, কারও বিষয় আবার পরিবেশ বিপর্যয়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর ভোক্তারা উৎপাদনপ্রণালি ও পরিবেশ নিয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠছে।
বেশ কয়েকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান আজ পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে বেশি নজরদারি নিশ্চিত করতে কাজ করছে। এর একটি দৃষ্টান্ত আমি আগেই উল্লেখ করেছি। এ ধরনের প্রচারণা বা প্রতিবাদকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো নিয়মিতভাবে সক্রিয় সহায়তা দিয়ে থাকে।
ভোক্তাসাধারণের ক্রয় সিদ্ধান্ত বা ক্রয়ক্ষমতা ধীরে ধীরে উৎপাদন পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, যার পেছনে ‘ক্লিন ক্লোথস ক্যাম্পেইন’ বা ‘মেইড বাই’-এর মতো কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব উদ্যোগে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা পরিবেশবান্ধব কাপড় পরার ব্যাপারেও প্রতিজ্ঞ। বিভিন্ন নিউজলেটার, প্রচারণা, ইন্টারনেট, সিনেমা (যেমন চায়না ব্লু) এবং গবেষণাপত্রের মাধ্যমে কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ সম্পর্কে তথ্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি পপতারকা, রেডিওর কথাবন্ধু (আরজে) এবং টেলিভিশন তারকাদের যুবক ও ফ্যাশন-সচেতন ভোক্তাদের ওপর প্রভাব বাড়ছে। যেমন—বিখ্যাত ইউটু ব্যান্ডের গায়ক বোনো ‘এডুন’ নামে তাঁর নিজের একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড শুরু করেছেন, যার প্রতিটি পোশাক আফ্রিকার লেসোথো ও তানজানিয়ার মতো দেশে উপযুক্ত কর্মপরিবেশে, উপযুক্ত শ্রম ব্যবহার করে উৎপাদন করা হয়।
ইউরোপ ও আমেরিকায় ভোক্তাদের নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভোক্তাদের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল পণ্যের উৎপাদন পরিবেশের সামাজিক এবং পরিবেশগত অবস্থা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। তাই খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের কাছে তাদের ভাবমূর্তির ব্যাপারে দিন দিন আরও সচেতন হয়ে উঠছে।
ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো ও খুচরা বিক্রেতারা, বিশেষ করে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তাদের এই সচেতনতার ব্যাপারে মনোযোগী। এবং এনজিওগুলোও এখন বোঝে যে তাদের পক্ষে একটি স্থায়ী উন্নয়নের জন্য অবদান রাখা সহজেই সম্ভব। সিএসআর ও ভোক্তা সচেতনতার কারণে আজ নাইকি, এডিডাস, রিবক, ম্যাটেল, লিভাইস, গ্যাপসহ অন্যান্য ব্র্যান্ড বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যার মাধ্যমে তারা কেবল সেসব কোম্পানির সঙ্গেই উৎপাদন-সংক্রান্ত চুক্তি করবে, যাদের উৎপাদন পরিবেশ মানসম্পন্ন।
এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপের বেশ কিছুসংখ্যক বস্ত্র কারখানা উৎপাদন ও অর্ডারের চাপ এবং সিএসআরকেন্দ্রিক বিভিন্ন বহুমুখী নীতি ও মান অনুসরণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
এসব নীতিমালা, মাননিয়ন্ত্রণ এবং নির্দেশনা সহজে ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ফরেইন ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের (এফটিএ) সঙ্গে যুক্ত এক দল রিটেইল কোম্পানি ‘বিজনেস সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ইনিশিয়েটিভ’ (বিএসসিআই) শীর্ষক একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, যার মাধ্যমে ইউরোপীয় উপায়ে উৎপাদন পরিবেশের সামাজিক মানদণ্ড অনুসরণ করে রিটেইল, কারখানা ও আমদানিকারকদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে উন্নয়ন সাধনে উদ্বুদ্ধ করা হবে।
এসব উদ্যোগের ফলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে গার্মেন্টস রিটেইলার এবং ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পণ্যের জন্য একটি সামাজিক ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পরিবেশ নিশ্চিত করাকে দায়িত্ব মনে করছে। এবং বোঝা যাচ্ছে, পরিবর্তনের এই সুবাতাস আমাদের শিল্প-কারখানাগুলোকেও ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে। এমন একটি লেখার কথা প্রথম যখন ভেবেছি, তখন মনে করেছিলাম, লেখাটির শিরোনাম হবে ‘মেইড ইন হেল’ বা ‘নরকে তৈরি’। কিন্তু সম্প্র্রতি আমাদের দেশের একটি ওভেন ফেব্রিক টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি ঘুরে এসে মত পাল্টাতে হলো। যে ফ্যাক্টরির পুরো পরিবেশই সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিবেশবান্ধব, যার মূলমন্ত্র ‘গো ফর গ্রিন’ বা ‘এসো সবুজে বাঁচি’। এর ইটিপি ফ্যাসিলিটিতে উৎপাদনে ব্যবহূত পানি পরিশোধন এবং পুনর্ব্যবহার করা হয় একটি বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে, যার বেতন-ভাতা এবং সর্বোপরি কাজের সুযোগ ও পরিবেশ অন্য দশটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদা মনে হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রতিষ্ঠানের স্বত্ব্বাধিকারী বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি অংশীদারের গুরুত্ব আমাদের কাছে সবার ওপরে।’ এসব দেখে এই প্রবন্ধের শিরোনাম পাল্টে দিয়ে লিখতে হলো ‘মেইড ইন হেভেন’- ‘স্বর্গে তৈরি’।
আমাদের বিশ্বাস, বাংলাদেশের সব শিল্পোদ্যোগ একদিন পরিবেশের বন্ধু হবে আর বাংলাদেশ হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশবান্ধব দেশ।
=========================
গল্পালোচনা- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...’  আন্তর্জাতিক- উইকিলিকসঃ হাটে হাঁড়ি ভাঙা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  গল্পসল্প- ওরা ধান কুড়ানির দল  শিক্ষা- আদিবাসী পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই  জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অর্থের মূল উৎস সৌদি আরব  রাজনৈতিক আলোচনা- এমন বন্ধু থাকলে...  শিল্প-অর্থনীতি শেয়ারবাজারের সুন্দরী প্রতিযোগিতা-তত্ত্ব  সাক্ষাৎকার- খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বিকল্প উপায় খুঁজতা হবে  খবর, প্রথম আলোর-  দলীয় স্বার্থ বড় করে দেখবেন না  মার্কিন কূটনীতিকদের গোপন তারবার্তাঃ পাকিস্তানে জঙ্গি নির্মূলে ১০-১৫ বছর লাগবে  অধ্যাপক ইউনূসের অর্থ স্থানান্তর : গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাখ্যা  শিল্প-অর্থনীতি 'সময় এসেছে মাথা তুলে দাঁড়াবার'  প্রকৃতি- 'কিয়োটো প্রটোকল ভেস্তে যাচ্ছে, কানকুনে কী হবে?  আলোচনা- 'মেয়েদের লাঞ্ছনা বন্ধ করতে কঠোর হতে হবে'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'আগ্নেয়গিরির ওপরে পিকনিক'  আলোচনা- 'হিমালয়ের কোলে এক টুকরো দক্ষিণ এশিয়া'  স্মরণ- 'মানুষের জন্য যিনি জেগে থাকতেন'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আবার আসিব ফিরে!'  আলোচনা- 'রাজকীয় সম্মেলন'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'অসারের তর্জন-গর্জন'  আলোচনা- 'একজন নোবেল বিজয়ী, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ'  স্মৃতি ও গল্প- সেই আমি এই আমি  গল্প- 'ঘুঁটি'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি : মিয়ানমারে কি কি গণতন্ত্র আসছে?  শিল্পি- শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র  সাহিত্যালোচনা- তান তুয়ান এঙের উপন্যাস দ্য গিফট গিফট অব রেইন  খবর- বন্ধ তাবানীতে লোক নিয়োগ  ইতিহাস- আমাদের ভাববিশ্ব ও বৌদ্ধবিহার  স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন  আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা


দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যর
লেখকঃ এ জেড এম সাইফুদ্দীন
পরিচালক, ফিন্যানশিয়াল এক্সিলেন্স লিমিটেড। যোগাযোগ বিশ্লেষক।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.