স্মরণ- 'রবীন্দ্রনাথ—সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে' by সৈয়দ আবুল মকসুদ

ড়াই হাজার বছরের সভ্য ও সংস্কৃতিমান বাঙালি জাতির যা কিছু মূল্যবান, তাকে আজ ঢেকে দিয়েছে আমাদের অস্বাভাবিক কলুষিত রাজনীতি। রাজনীতি ছাড়া আজ আমাদের জীবনে যেন আর কিছুই নেই। রাজনীতির নোংরায় নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের সুকুমারবৃত্তিসমূহ। বাঙালির সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন, বাঙালির ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবন রাজনীতির চড়ায় আটকে গেছে।
সকাল থেকে মধ্যরাতে ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত অপ্রীতিকর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ অধিকার করে আছে রাজনীতি। এর সঙ্গে সংস্কৃতির নামে যে জিনিস দেখা যায়, তা চিরকালের বাঙালি সংস্কৃতি নয়; সংস্কৃতির নামে এক বিকৃত বস্তু, যাকে অনেকে নাম দিয়েছেন অপসংস্কৃতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি সংস্কৃতির সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তাঁর মধ্যেই প্রকাশ ঘটেছে একই সঙ্গে বাঙালির সৌন্দর্যবোধ ও মননশীলতার উপাদানসমূহ, সর্বাধিক পরিমাণে। বাংলা সাহিত্যের তিনি সর্বকালের সবচেয়ে বড় প্রতিভা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান প্রভৃতি শুধু নয়; সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই, যা তিনি স্পর্শ করেননি। গুণগত ও পরিমাণগত উভয় দিকেই তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অনতিক্রম্য। বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনিই এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। শুধু শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা বিরাট। এবং তাঁর গঠনমূলক ও সাংগঠনিক কাজের পরিমাণও বিশাল। যে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা তাঁকে একজন মহান কর্মযোগীর মর্যাদায় ভূষিত করেছে। আগামী পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী।
গত ৮ মে থেকে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতে। বছরব্যাপী এই কার্যক্রম চলবে। আগামী পঁচিশে বৈশাখ এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটবে।
রবীন্দ্রনাথ সব দেশের, সব অঞ্চলের বাঙালির অভিন্ন সম্পদ। বাংলাদেশ ও উপমহাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভাগাভাগি হওয়ার আগেই তিনি পরলোক গমন করেন। তিনি ভারতের, না বাংলাদেশের—এই প্রশ্ন তোলা মূর্খতার নামান্তর। গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত যৌথ ইশতেহারে বলা হয় যে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালন করবে। এটি ছিল গত ৩৯ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের সবচেয়ে সুন্দর সিদ্ধান্ত।
যৌথ ইশতেহারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল। এতে রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, নাট্যশিল্পী, শিক্ষাবিদ প্রভৃতি। এতে আছেন সাবেক সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমপি এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী (বেগম খালেদা জিয়া)। আমার মতো অভাজনকেও কমিটিতে রাখা হয়েছে। এরশাদ সাহেবের রোল নম্বর দুই, বিরোধীদলীয় নেত্রীর ক্রমিক নম্বর ১১ এবং আমার রোল নম্বর ১৪৭। তবে সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী যে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর অমূল্য সময় কিছুটা খরচ করতে পারবেন সে আশা দুরাশা। তবু তাঁকে রাখা হয়েছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ২৩ গুণ বড়। সে দেশে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে বহু গুণ বেশি। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর সংখ্যা আরও বেশি। ভারতের কমিটি আমাদের কমিটির চেয়ে অনেক ছোট—সদস্যের সংখ্যা চার ভাগের এক ভাগ, মাত্র ৩৬। কমিটিতে লোকের সংখ্যা প্রচুর হলেই কাজের পরিমাণ হবে বিপুল, তা নয়। বরং আমার ধারণা, যেখানে লোক যত বেশি, সেখানে দেখা যাবে কাজের সময় লোক পাওয়া যাবে তত কম। হাজার খানেক অকাজের লোক থাকার চেয়ে, কাজের মানুষ দশজনই যথেষ্ট। আমার মতো অকম্মাকে কমিটিতে না রাখলেও, সরকার রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে ডাকলে আমি আনন্দের সঙ্গে খাটাখাটনি করে দিতাম। এ কথা আমি উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম। তাঁরা বললেন, কমিটিতে নাম না রাখলে অনেকে মন খারাপ করেন, কেউ কেউ রাগও করেন। আমি বললাম, তা বটে। বাংলাদেশে কাজ করার চেয়ে মন খারাপ করা সহজ, রাগ করা আরও সহজ।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে শুধু গান শেখাননি, তিনি শিখিয়েছেন রুচিজ্ঞান ও পরিমিতিবোধ। তবে তিনি শেখালেই যে শিখব, তেমন জাতি আমরা নই। তাই দেখছি, রবীন্দ্রনাথ শিখিয়ে গেলেও আমাদের রুচিজ্ঞান ও রসবোধ উন্নত হয়নি, মাত্রাজ্ঞান সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
জাতীয় কমিটি গঠন করার সময় এর কাজের পরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছিল: ক. নীতিনির্ধারণ ও যথাযথ মর্যাদাসহ সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালনসংক্রান্ত যথোচিত নির্দেশনা প্রদান এবং খ. জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন-সংক্রান্ত সময় ও কর্মসূচিসংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান।
পরামর্শ বা উপদেশ দেওয়ার চেয়ে সহজতম জিনিস আদম-হাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই গ্রহে দ্বিতীয়টি ছিল না। সুতরাং সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার মওকা যখন একবার পাওয়া গেছে, তার সদ্ব্যবহার ১৫৫ জনের বিপুল অধিকাংশই যে করবেন, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পরামর্শের প্রবলতায় শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নাভিশ্বাস ওঠে কি না বলা যায় না।
এর মধ্যেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক ‘কার্যপত্রে’ দেখেছি যে ‘সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ১৩৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে আরও সদস্য অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জাতীয় কমিটির সভার পরে তা চূড়ান্ত করা হবে।’ জাতীয় কমিটির সভার আগেই সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২০ এপ্রিল ও ১৩ জুন দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অন্তত ৩১টি প্রস্তাব ‘জাতীয় কমিটির সভায় বিবেচনার জন্য’ উত্থাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ব্যুরোক্রেসিকে ভয় করতেন, তাঁর আত্মা সম্ভবত ভয় করে আরও বেশি।
ওই যে ‘আরও সদস্য অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টি’র কথা বলা হয়েছে, সেটাই বিপদের আশঙ্কার বড় কারণ। প্রধানমন্ত্রী নিজেই একটি চমৎকার প্রস্তাব করেছেন। কবির সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি ‘মৈত্রী ট্রেন’ চালু হবে। কমিটির সদস্যসংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে মৈত্রী ট্রেনের উদ্বোধনী যাত্রায় কমিটির বাইরের সাধারণ যাত্রীদের অনেকে তাঁদের স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে কালোবাজারে টিকিট কেটেও কলকাতায় যেতে পারবেন, সে ভরসা নেই। এমনকি কমিটির সদস্যদের মধ্যে বুড়োগোছের অনেকে ট্রেনের বগির হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে জয়দেবপুর পর্যন্ত যেতে পারেন কি না সন্দেহ। টানাটানি, ধাক্কাধাক্কিতে হয়তো বহু সদস্য ট্রেনেই উঠতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলাটি ট্রেনে অন্য কারও সঙ্গে চলে যাবে শিয়ালদহ স্টেশনে।
কমিটির প্রথম সভাটি হয়েছে ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে। অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত ছিলেন এবং পরামর্শ দেওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করেননি অনেকেই। সবার পরামর্শ যদি সরকার বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে বর্তমান অর্থবছরে আর কোনো কাজ করতে পারবে না। সভার শুরুতে ‘প্রস্তাবাবলিসহ গৃহীতব্য কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা উপস্থাপন’ করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব। তিনি ‘যৌথ কার্যক্রমের জন্য প্রাপ্ত প্রস্তাবসমূহ’ উপস্থাপন করেন। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে:
‘যৌথ/যুগপৎ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন, উদ্বোধনী দিনে উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের নেতাদের উপস্থিতি, বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ক্রোড়পত্র প্রকাশ, বিশ্বকবির গবেষণা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত গুণীজন সংবর্ধনা, সম্মাননা ও পদক প্রদান এবং বিভিন্ন ধরনের যৌথ কার্যক্রম (সংগীত, নৃত্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রপ্রদর্শনী, আলোচনা, সেমিনার, নাট্য কর্মশালা, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রস্তাবিত যৌথ অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রবীন্দ্র-চেয়ার প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ-ভারতের বাইরে তৃতীয় দেশের জন্য রবীন্দ্র বৃত্তি প্রদান, যৌথ প্রকাশনা, স্যুভেনির প্রকাশ, ছবি, ভিডিওচিত্র, দুই দেশের শিল্পীদের রবীন্দ্রসংগীতের যৌথ সিডি রেকর্ডিং ও প্রকাশ, সাংস্কৃতিক দল বিনিময়, কবিগুরুর গবেষণা ও অন্যান্য বিষয়ে সম্পৃক্ত ১০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য ভিসা সহজীকরণ, ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘরের আয়োজন, পদ্মাবোটের অনুকরণে বোট নির্মাণ ও শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে একটি বোট বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান। এ ছাড়া যৌথ ও বহুপক্ষীয় কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারত ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়সমূহ নির্ধারণ করার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
[জাতীয় কমিটির প্রথম সভার কার্যবিবরণী, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়]
প্রধানমন্ত্রী সভার শুরুতে কিছু বলেন কবি সম্পর্কে। তারপর তিনি আমাদের মতামত আহ্বান করেন। ড. সন্জীদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত রবীন্দ্র-চেয়ার প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে এবং পরে তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। ড. আনিসুজ্জামান বলেন, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন দুই দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে হওয়ায় ক্ষতি নেই, বরং তাতে উভয় দেশে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হবে এবং উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উভয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন। সেলিনা হোসেন বলেন, রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী এবং নজরুলের ১১২তম জন্মবার্ষিকীও বাংলাদেশ-ভারত কর্তৃক যৌথভাবে উদ্যাপিত হতে পারে। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান জানান, এ বছর ‘রবীন্দ্র পদক’ প্রবর্তন করেছে একাডেমী। প্রথমবার দুজন গুণী ব্যক্তিকে এই পদক দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বারবার সবাইকে বসে বসেই পরামর্শ দেওয়ার জন্য বলছিলেন। সরকারের বহু নির্দেশ যেমন পালন করার প্রয়োজন মনে করেন না অনেকেই, সেদিন অবশ্য সৌজন্যতাবশত সরকারপ্রধানের ওই নির্দেশ না মানাই সমীচীন মনে করেন কমিটির সদস্যরা। সৈয়দ শামসুল হকের প্রস্তাব ছিল একটু ব্যতিক্রমী। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনটি ‘গণতন্ত্র চেতনা দিবস’ হিসেবে পালন করার ব্যবস্থা করা হোক। পিনপতন নীরবতার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীই তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘না-না-না, কোনো দরকার নাই।’ তারপর সৈয়দ হক প্রস্তাব করেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানও যেন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নানা রকম প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক পরামর্শ উত্থাপিত হতে থাকে। হাসিমুখে ধৈর্যসহকারে প্রধানমন্ত্রী সব শোনেন প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী। অসীম সাহা বলেন, শুধু রবীন্দ্রগবেষকই নন, সব শ্রেণীর সংস্কৃতিকর্মীর জন্য ভারত কর্তৃক ভিসা সহজীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা সমীচীন হবে। নির্মলেন্দু গুণ ঢাকার একটি বড় রাস্তার নাম রবীন্দ্রনাথের নামে করার প্রস্তাব করেন এবং বাংলাদেশি টাকায় কবির ছবি মুদ্রণের দাবিও করেন।
সভাপ্রধানের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উত্থাপিত মতামত যত দূর সম্ভব গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। তিনি নিজে একটি চমৎকার প্রস্তাব করেন। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করছেন এমন শিক্ষার্থীদের জন্য ‘বাংলাদেশ ভবন’ নামে একটি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে মৈত্রী ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার নাম ‘সোনার তরী’।
আমি যে দুটি প্রস্তাব করার প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম, তা আগেই উত্থাপিত হওয়ায় বেঁচে যাই। আমি বলতে চেয়েছিলাম, শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশের একটি ভবন থাকা দরকার, যেখানে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা হবে এবং কবির নামে ঢাকার একটি প্রধান সড়কের নামকরণ। আমি যতটা জানি তা হলো, প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা যখন ডিগ্রি নিতে বিশ্বভারতীতে যান, তখন তিনি এ ধরনের একটি ভবন নির্মাণের মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মধ্যাহ্নভোজের সময় আমার দাবি দুটিও প্রধানমন্ত্রীকে নিবেদন করি। আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি আমার কথা শুনলেন এবং বাস্তবায়নে সব চেষ্টা করা হবে বলে আশ্বাস দিলেন।
রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে উদ্যাপন করবে বলে ঘোষিত হলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। ভারত কাজ শুরু করেছে এবং এগিয়ে গেছে অনেক দূর। শান্তিনিকেতনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণার জন্য ইউনেসকোর কাছে আবেদন করেছে ভারত সরকার। বাংলাদেশ শিলাইদহের কুঠিবাড়ির জন্য আবেদন করতে পারত। করেছে কি না, তা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে ফোন করে আমি জানতে পারিনি। ভারতীয় রেলওয়ে পাঁচ কামরার একটি ট্রেনে বিশেষ রবীন্দ্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘সংস্কৃতিযাত্রা’। পাঁচটি বগির যাত্রীদের বসার আসন সরিয়ে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম ও স্মৃতিস্মারকে সজ্জিত করা হয়েছে। পাঁচটি কোচের নাম দেওয়া হয়েছে ‘জীবনস্মৃতি’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘মুক্তধারা’, ‘চিত্ররেখা’ ও ‘শেষকথা’। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বগিগুলোর বহিরঙ্গ সজ্জা ও ডিজাইন করেছেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী।
আমরা হাজারো কাজ করব বলে পরিকল্পনা করে কোনো কাজই সুন্দরভাবে করতে পারছি না। শেষ মুহূর্তে তিন তুড়িতে কাজ করতে গিয়ে টাকার শ্রাদ্ধ হবে, কাজটিও ঠিকমতো করা হবে না।
আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অন্য সমস্যাও আছে। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেননি, তবে তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তাঁর নির্দলীয় রাজনীতি ছিল শুভবুদ্ধির রাজনীতি। কিন্তু বারবার তিনি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের রাজনীতির শিকার হয়েছেন। তা হয়েছেন জীবনকালে ও মৃত্যুর পরও।
রবীন্দ্রনাথ মারা যান অখণ্ড ভারতে, কিন্তু পাকিস্তান তাঁকে নিজের কবি বলে স্বীকার করেনি। পাকিস্তানে তিনি ছিলেন পথভোলা এক পথিক, শাসকেরা তাঁকে চিনতেন না। তাঁর জন্মশতবর্ষ তাঁরা যথাযথ মর্যাদায় পালন করেননি। তবে সরকারের অবহেলা পুষিয়ে দিয়েছেন বাঙালি সংস্কৃতিসেবীরা। পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটতে বাঙালি ভালোবাসে। এবারও ঘাঁটা শুরু হয়েছে। কারণ বাঙালির কাছে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চেয়ে অতীত প্রিয়। এবারও আইয়ুব খানকে আসামি বানিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে স্বস্তি পাবে না বাঙালি।
একটি উচ্চতর সংস্কৃতির নাম রবীন্দ্রনাথ। রুচিশীলতা ও যুক্তিশীলতার নাম রবীন্দ্রনাথ। অবস্থা দেখে মনে হয়, দুই বাংলার একশ্রেণীর রবীন্দ্রপ্রেমিক মনে করেন, লম্বা পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা, কৃত্রিম ভঙ্গিতে হাঁটাচলার নাম রবীন্দ্রসংস্কৃতি। একটি শ্রেণী ফুল-চন্দনখচিত একটি ঘরে কবিকে আটকে রাখার পক্ষপাতী। সার্ধশত জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কলকাতার একটি চ্যানেল গানের ওপারে নামে একটি ধারাবাহিক করছে গত বৈশাখ থেকে। আমার স্ত্রী ও মেয়ে প্রতিদিন সেটা দেখে। কখনো আমিও একটু দেখি। মূল চরিত্রটি একজন রবীন্দ্রগবেষক। সিরিয়ালটিতে দেখাতে চাইছেন রবীন্দ্রনাথকে ঠাকুর বানিয়ে কেউ পূজা করছেন, কেউ তাঁকে নিয়ে করছেন ব্যবসা।
আরেক সমস্যা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয়, রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে। রক্ষণশীলেরা মনে করেন, রবীন্দ্রসংগীত যক্ষের ধন। তা শুধু হারমোনিয়াম, তানপুরা ও তবলার চাঁটিসহ গীত হবে। কিন্তু মানুষ বেশি দিন একঘেয়ে জিনিস পছন্দ করে না। ওই ধারাবাহিকটির বক্তব্য হলো, রবীন্দ্রসংগীতকেও যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বদলাতে হবে। তা না হলে তা সেকেলে হয়ে যাবে। কেউ যদি গিটার বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গায়, তাতে ক্ষতি কী? রবীন্দ্রনাথকে সবাই ধারণ করুক।
জাতির মহত্তম সৃষ্টিশীল প্রতিভার শতবর্ষ বা সার্ধশতবর্ষ একবার করেই আসে। জাতি যদি উপযুক্ত হয়, তাহলে উপলক্ষটিকে ষোলআনা কাজে লাগাতে পারে। জাতি যদি অযোগ্য হয়, তাহলে উপলক্ষটা তার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে। অগোছালোভাবে ও দায়সারা গোছে কাজ করা রবীন্দ্রনাথ অপছন্দ করতেন। তাঁর ১৫০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমরা যদি তা-ই করি, তা হবে কবির প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের নামান্তর। আর যদি রুচি ও নৈপুণ্যের প্রকাশ ঘটে, সেটাই হবে উপলক্ষটির জন্য উপযুক্ত।
============================
স্মরণ- 'জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী'  আলোচনা- 'প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন পর্যায়'  আলোচনা- 'কর্মপরিবেশঃ স্বর্গে তৈরি'  গল্পালোচনা- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...’  আন্তর্জাতিক- উইকিলিকসঃ হাটে হাঁড়ি ভাঙা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  গল্পসল্প- ওরা ধান কুড়ানির দল  শিক্ষা- আদিবাসী পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই  জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অর্থের মূল উৎস সৌদি আরব  রাজনৈতিক আলোচনা- এমন বন্ধু থাকলে...  শিল্প-অর্থনীতি শেয়ারবাজারের সুন্দরী প্রতিযোগিতা-তত্ত্ব  সাক্ষাৎকার- খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বিকল্প উপায় খুঁজতা হবে  খবর, প্রথম আলোর-  দলীয় স্বার্থ বড় করে দেখবেন না  মার্কিন কূটনীতিকদের গোপন তারবার্তাঃ পাকিস্তানে জঙ্গি নির্মূলে ১০-১৫ বছর লাগবে  অধ্যাপক ইউনূসের অর্থ স্থানান্তর : গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাখ্যা  শিল্প-অর্থনীতি 'সময় এসেছে মাথা তুলে দাঁড়াবার'  প্রকৃতি- 'কিয়োটো প্রটোকল ভেস্তে যাচ্ছে, কানকুনে কী হবে?  আলোচনা- 'মেয়েদের লাঞ্ছনা বন্ধ করতে কঠোর হতে হবে'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'আগ্নেয়গিরির ওপরে পিকনিক'  আলোচনা- 'হিমালয়ের কোলে এক টুকরো দক্ষিণ এশিয়া'  স্মরণ- 'মানুষের জন্য যিনি জেগে থাকতেন'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আবার আসিব ফিরে!'  আলোচনা- 'রাজকীয় সম্মেলন'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'অসারের তর্জন-গর্জন'  আলোচনা- 'একজন নোবেল বিজয়ী, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ'  স্মৃতি ও গল্প- সেই আমি এই আমি  গল্প- 'ঘুঁটি'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি : মিয়ানমারে কি কি গণতন্ত্র আসছে?  শিল্পি- শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র  সাহিত্যালোচনা- তান তুয়ান এঙের উপন্যাস দ্য গিফট গিফট অব রেইন  খবর- বন্ধ তাবানীতে লোক নিয়োগ  ইতিহাস- আমাদের ভাববিশ্ব ও বৌদ্ধবিহার  স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন  আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার


দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যর
লেখকঃ সৈয়দ আবুল মকসুদ
গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.