‘আয়নাঘরে’ থাকার যে বর্ণনা দিলেন আমান আযমী
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে ভার্চ্যুয়ালি উপস্থিত হন আবদুল্লাহিল আমান আযমী। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর প্রয়াত গোলাম আযমের ছেলে। ২০১৬ সালের ২২শে আগস্ট রাতে আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয় বলে পরিবার জানায়। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বার বার মনে হতো, তারা হয়তো আমাকে ক্রসফায়ার করে হত্যা করবে। আমি তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে শুধু কান্না করতাম। আমার লাশটা যেন আমার পরিবারের কাছে যায়।
তিনি বলেন, দেশে যে বিপ্লব হয়েছে সেটি আমি জানতাম না। আগস্টের ৫ তারিখে রাত সাড়ে দশটার সময় এসে আমাকে বলা হলো আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বললাম, আমি তো ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাই। যদি দুইটার দিকে আসেন তবে সুবিধা হয়। কয়েকদিন আগেই ডাক্তার দেখে গেছেন, রক্ত পরীক্ষা করলেন। এখন আবার কোথায় নিয়ে যাবেন। পরে আমাকে মুখোশ পরিয়ে আশপাশের আরেকটি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি বললাম, আট বছর ধরে আপনাদের বলেছি আমার দাঁত ভেঙে গেছে। আমার কানের সমস্যা হচ্ছে। এতদিন আপনাদেরকে বলেছি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান, আপনারা নিয়ে যান না। আর এখন বলছেন হাসপাতালে যেতে হবে এটা কেমন কথা। পরে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে, তার শেষ নাই। আমি বললাম ঢাকা শহরের কোনো হাসপাতাল তো এত দূরে না। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কেউ কোনো জবাব দিলো না। রাস্তা ভাঙাচোরা। আমি জানতে চাইলাম, ঢাকা শহরের কোনো রাস্তা তো এতো ভাঙাচোরা না। আপনারা কি আমাকে কোনো গ্রামের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন নাকি? তারা কোনো জবাব দিলো না। পরে আমাকে আরেকটি বন্দিশালায় নিয়ে গেল। এখন আমি যেটা অনুমান করতে পারি, রাস্তায় ছাত্র-জনতা যেভাবে গাড়ি চেক করছিল এজন্য তারা আমাকে গ্রামের রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছেন। পরে তারা বললেন, আপনি এখানে থাকেন। আমি বললাম, আপনারা না আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন এটা কোথায় নিয়ে আসলেন? বলা হলো, আপনাকে পরে জানানো হবে। ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ৬ই আগস্ট আমাকে একজন জানালেন, আজ আমাকে মুক্তি দেয়া হতে পারে। একজন বললেন, আপনার কাপড়ের সাইজ বলেন। আমি বললাম, আমি তো গার্মেন্টসের কাপড় পরি না, সাইজ বলতে পারবো না। পরে একটা কাপড় নিয়ে আসা হলো। যেটা আপনারা দেখেছেন মুক্তির পরে প্যান্ট-শার্ট। ওটা পরে দেখলাম ঠিক আছে। বাইরে কি হচ্ছে সে খবরই তো নাই আমার কাছে। পরে সোয়া ৯টার দিকে আমাকে নিয়ে তারা রওনা হলো। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা সড়কের পাশে আমাকে নিয়ে তারা ছেড়ে দিলেন। বলা হলো, গাড়ি আসবে গাড়িতে উঠে আপনি চলে যাবেন। তখন রাত পৌনে বারোটা বাজে। পরে তারা আমাকে টাকা দিলো। আমি জানতে চাইলাম ঢাকায় যাওয়ার ভাড়া কতো? তারা বললেন, ঠিক জানি না। জানতে চাইলাম এখানে কতো টাকা আছে। তারা বললেন, পাঁচ হাজার টাকা। আমি বললাম, আমি আপনাদের টাকার মুখাপেক্ষী নই। এখান থেকে ঢাকার ভাড়া যতটুকু ততটুকু টাকা দেন। তারা বললেন, আপনি যা করেন, দান করেন, কিছু টাকা আপনাকে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে এক সেকেন্ড কথা বলার আমার রুচি ছিল না। এরপর তারা আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না। এরপর দেখলাম একটা গাড়ি আসছে। তখন আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে বাসের মধ্যে উঠি। কীভাবে যে আমি ১০০ মিটারের মতো রাস্তায় দৌড়ে বাসে উঠেছি এখনো কল্পনা করতে পারি না। পরে বাসে উঠলাম। আমার স্ত্রী এবং চাচাতো ভাইয়ের ফোন নম্বর আমার মনে ছিল। একজনের থেকে ফোন নিয়ে তাদের ফোন করে বললাম। বাস আমাকে টেকনিক্যাল মোড়ে নামিয়ে দিলো। এরপর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে ৮ তারিখ ভোরে বাসায় পৌঁছালাম।
গুম হওয়ার আগের ঘটনা বর্ণনা করে আবদুল্লাহিল আমান আযমী আরও বলেন, যখন আমার বাসায় তারা এলো, তখন তাদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম, আপনারা কারা, পরিচয় কী, পরিচয়পত্র দেখান। আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো ওয়ারেন্ট আছে কিনা, তা জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমার কথার জবাব দেয়নি। তিনি বলেন, একপর্যায়ে আমাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠায়। আমার চোখমুখ বাঁধা অবস্থায় একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ফেলে রাখা হয়, অন্ধকার এক ঘরে। টয়লেট যেতে চাইলে চোখ হাত বেঁধে নিয়ে যেত।
আযমী বলেন, আমার দিনগুলো কেমন কেটেছে মনে হলে বুক ফেটে যায়। একদিন আমাকে এসে বলা হলো, আপনার লিখিত দিতে হবে। সেখানে আপনি লিখবেন, আমি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবো না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বিদেশে সুখে শান্তিতে থাকতে চাই। আমি বিদেশে চলে যাবো, তখন আমি বলেছি, আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আপনারা আমাকে অবৈধভাবে অপহরণ করেছেন। আটক করে রেখেছেন, আমাকে নির্যাতন করছেন। আমি এটার প্রতিবাদে মিছিল মিটিং করতে পারছি না। তাই মৌন প্রতিবাদ হিসেবে বড় চুল রেখেছি। আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা আমি রাজনীতি করবো কি করবো না, আমি এ দেশে থাকবো কি থাকবো না। আল্লাহ আমাকে সেই সৎ সাহসটুকু দিয়েছিলেন। আমি এটা দৃঢ়ভাবেই বলেছি।
No comments