ঐতিহাসিক সিরিজ জয় by সৌরভ কুমার দাস

ইতিহাস থেকে তখন ১০ রান দূরে বাংলাদেশ, রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়ামের বক্সে বেজে উঠলো ‘জিতেগা ভাই জিতেগা!’ স্বয়ং ডিজেই বললেন সেটা, সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারি থেকেও ভেসে আসলো ‘বাংলাদেশ জিতেগা!’ ৫৬তম ওভারে আবরার আহমেদের অফ স্টাম্পের বাইরে বল কাভার দিয়ে চার হাঁকান সাকিব। সঙ্গে সঙ্গে স্টেডিয়ামের সাউন্ডবক্সে বেজে উঠলো, ‘লাল সবুজের বিজয় নিশান হাতে হাতে ছড়িয়ে দাও...’ স্টাম্প মাইকে শোনা গেল মুশফিকুর রহীমের বজ্র হুঙ্কার! ড্রেসিংরুম থেকে ছুটতে ছুটতে গলা ফাটিয়ে উল্লাস করছেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও। বাকিরাও মাঠের দিকে ছুটলেন বিদ্যুৎ গতিতে! এমন ঐতিহাসিক জয়ে উদ্‌যাপনটা তো বাঁধনহারাই হবে। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জয়। ঐতিহাসিকই তো বটে।

গতকাল রাওয়ালপিন্ডিতে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে পাকিস্তানকে ৬ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। এর আগে প্রথম টেস্টে একই মাঠে ১০ উইকেটে জিতেছিল টাইগাররা। সেটি ছিল প্রথমবার পাকিস্তানের মাটিতে জয় আর গতকালেরটা স্বাগতিকদের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়। সব মিলিয়ে পাকিস্তানে ২০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। ফল প্রতিবারই পরাজয়ের হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়া। এই টেস্ট সিরিজের আগে পাকিস্তানের মাটিতে এটাই ছিল বাংলাদেশের পরিসংখ্যান।

আর টেস্টে তো পৃথিবীর কোথাও জয় ছিল না পাকিস্তানের বিপক্ষে। সর্বোচ্চ সাফল্য ২০১৫ সালে খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে করা ড্র। সিরিজ শুরুর আগে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় অধিনায়ক শান্তকে। উত্তরে তিনি বলেন, আমি মনে করি, এটি (পাকিস্তান ২০-০ বাংলাদেশ) শুধুই রেকর্ড। রেকর্ড বদলাতেই পারে। কাজটা সহজ হবে না। তবে যেটা বললাম, আমাদের দল খুব ভারসাম্যপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি, এবার বিশেষ কিছু করতে পারবো।’ সেই বিশ্বাস নিয়েই এবার পাকিস্তানে ইতিহাস গড়লো শান্তর দল। দেশের বাইরে বাংলাদেশের মাত্র দ্বিতীয় সিরিজ জয় এটি। তবে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ২-০ ব্যবধানে জিতলেও সেবার চুক্তি সংক্রান্ত ঝামেলায় খেলেননি শীর্ষ ক্রিকেটারদের কেউ। বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছিল দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষে। ফলে এবারের জয় তাই অনেক বেশি স্পেশাল, আর স্মরণীয়। এর জন্য আরও একটি কারণ আছে। ঘরের মাঠে এর আগে একবারই টেস্টে ধবলধোলাই হয়েছে পাকিস্তান, ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। দ্বিতীয় দল হিসেবে বাংলাদেশ এবার শান মাসুদ-বাবর আজমদের এই তেতো স্বাদ দিলো।

ইতিহাস গড়ার মিশনে চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশকে তাড়া করতে হতো ১৮৫ রান। চতুর্থদিন বিকালে জাকির হাসান আগ্রাসী খেলেই মোমেন্টাম তৈরি করেন। নতুন বলে তার এমন আক্রমণে এলোমেলো হয় পাকিস্তানের বোলারদের সব পরিকল্পনা। মাত্র ৭ ওভারে খেলা হয় সেদিন বিকালে। এরপর আলোক স্বল্পতায় আর খেলা হয়নি। তবে তার মধ্যেই ৪২ রান তুলে পাকিস্তানকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেন তিনি।

গতকাল পঞ্চম দিনের শুরুতেই সাদমান ও জাকিরের ওপেনিং জুটিতে পূর্ণ হয় ৫০ রান। তবে এরপর জাকির ও সাদমান দ্রুত বিদায় নেন। পাকিস্তানি পেসার মীর হামজার দুর্দান্ত ডেলিভারি জাকির হাসানের ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে ভেঙে দেয় স্টাম্প। আগের দিন ২৩ বলে ৩১ রান করা ওপেনার আউট হন ৩৯ বলে ৪০ রান করে। কিছুক্ষণ পরই ফাঁদে পা দেন সাদমান। বারবার তাকে ড্রাইভ করতে প্রলুব্ধ করছিলেন পাকিস্তানি বোলাররা। সেই ফাঁদে পা দিয়ে ড্রাইভ খেলেই মিড অফে সহজ ক্যাচ দেন তিনি। তার আগে করেন ২৪ রান।

অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত চলতি সিরিজের আগের ২ (এক ইনিংসে ব্যাটিং প্রয়োজন হয়নি) ইনিংসে রান পাননি। অধিনায়ক হিসেবে ঐতিহাসিক মুহূর্তে যেন নিজের দায়িত্বটা বুঝতে পারলেন। মুমিনুল হক সৌরভকে নিয়ে আঁকড়ে থাকেন উইকেটে। শুরুতে কিছু আলগা শট খেললেও আস্তে আস্তে দু’জনই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। লাঞ্চের আগেই তাদের জুটিতে ৫০ আর দলের রান ১০০ পার হয়। তবে লাঞ্চের পর আর সেটা বেশিক্ষণ টেকেনি। পাকিস্তানি স্পিনার সালমানকে রিভার্স সুইপে চার মারার পরের বলে শর্ট লেগে ক্যাচ দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক (৮২ বলে ৩৮)। টানা ৯ ইনিংসে ফিফটির দেখা পেলেন না তিনি। এতে ভাঙে মুমিনুলের সঙ্গে তার ৫৭ রানের জুটি। এর কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ আবরার আহমেদকে উড়িয়ে মারতে যান মুমিনুল। ঠিকমতো টাইমিং না হওয়ায় বল উঠে যায় শর্ট মিড উইকেটে। আউট হওয়ার আগে করেন ৩৪ রান। জয়ের জন্য তখনো ৩৪ রান প্রয়োজন বাংলাদেশের। আকাশে তখন মেঘ, মাঠকর্মীরা কাভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মাঠে। তবে এগুলোতেও তাড়াহুড়ো করেননি সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহীম। বৃষ্টির শঙ্কা মাথায় নিয়ে সতর্কভাবে দলের জয় নিশ্চিত করেন। তাদের ৩৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি আসে ১২ ওভারে। সাকিব শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ২১ রানে, মুশফিক ২২ রানে।

এর আগে এই ম্যাচের প্রথম দিন বৃষ্টিতে ভেসে গেলেও দ্বিতীয় দিন মেহেদী হাসান মিরাজের ৫ উইকেটের সৌজন্যে টস হেরে ব্যাট করতে নামা পাকিস্তানকে ২৭৪ রানে অলআউট করে বাংলাদেশ। তবে এরপর নিজেরা ব্যাটিংয়ে নেমে দ্বিতীয় দিন বিকালটা স্বস্তি নিয়ে কাটালেও তৃতীয় দিন সকালেই ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। ২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে টাইগাররা। ওই মুহূর্তে যখন ধুঁকছিল বাংলাদেশ, মান বাঁচানোই যখন মনে হচ্ছিলো বড় দায় তখন প্রতিরোধ গড়েন লিটন কুমার দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজ। শুরুতে আক্রমণ করে চাপ দূর করেন মিরাজ, পরে লিটন খেলেন অনবদ্য ১৩৮ রানের ইনিংস। মিরাজ ৭৮ রানে ফেরেন, যদি জুটির সিংহভাগ কৃতিত্ব মিরাজকেই দেন লিটন। সেখান থেকে ২৬২ রানে থামে বাংলাদেশের ইনিংস।

এই পরিস্থিতি থেকে ম্যাচ জয় রূপকথার মতোই। সেখান থেকে এভাবে ম্যাচ জয় তো রূপকথার মতোই। প্রথম ইনিংসে এত কম রানে ৬ উইকেট হারিয়েও জয় টেস্ট ক্রিকেটে দেখা গেল ১৩৭ বছর পর! সেই ১৮৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ১৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ও পরে ৪৫ রানে অলআউট হয়েও শেষ পর্যন্ত ১৩ রানে ম্যাচ জিতেছিল ইংল্যান্ড। এবার বাংলাদেশও এই রেকর্ডে তাদের সঙ্গী হলো।
১২ রানের লিড পেলেও বাংলাদেশি বোলারদের তোপের মুখে দ্বিতীয় ইনিংসেও সুবিধা করতে পারেননি পাকিস্তানি ব্যাটাররা। স্বাগতিকরা ১৭২ রানে গুটিয়ে দেয় টাইগাররা। বাংলাদেশের হয়ে পেসার হাসান মাহমুদ নেন ৫ উইকেট, নাহিদ রানা ৪ উইকেট। বাকি উইকেটটি নেন তাসকিন আহমেদ। এবারই প্রথম টেস্টের কোনো ইনিংসে বাংলাদেশের পেসাররা মিলে ১০ উইকেট নেন।

No comments

Powered by Blogger.