প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সম্পাদকদের বৈঠক: সংস্কারের রূপরেখা দ্রুত উপস্থাপনের তাগিদ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকরা। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংস্কারের রূপরেখা, সরকারের মেয়াদ, মুক্ত গণমাধ্যম বিরোধী আইনের বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। এ ছাড়া সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে  বৈঠকের বিষয় অবহিত করা হয়। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং সরকারের এজেন্ডা বা সংস্কারের রূপরেখাকে দ্রুত জনগণের সামনে উপস্থাপনের তাগিদ দিয়েছেন বেশির ভাগ সম্পাদক। এতে বলা হয়, মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ও প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদকদের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভা প্রসঙ্গে পরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘সবাই বলেছেন যে, মিনিমাম দুই বছর বা দুই বছরের একটু কম যাতে এ গভর্নমেন্টের মেয়াদ হয়। বাট বেশির ভাগই যৌক্তিক সময় নিয়েও বলতে চাননি। তারা বলেছেন, যে এজেন্ডা বা যে কাজটা তারা করবেন সেই কাজটাই আসলে ডিটারমাইন করবে তারা কতোদিন থাকবেন।’

এ বিষয়টি সম্পাদক পরিষদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ সম্পর্কে সংগঠনটির বক্তব্য হলো আজকের (গতকাল) সভায় উপস্থিত সম্পাদকদের বেশির ভাগই সম্পাদক পরিষদের সদস্য। উপস্থিত সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ প্রধান উপদেষ্টার জানতে চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে সরকারের মেয়াদ নিয়ে কথা বলেছেন। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত বেশির ভাগ সম্পাদকই সরকারের মেয়াদ নিয়ে কিছু বলেননি। তারা দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, জনমানুষ ও কারখানার নিরাপত্তা এবং এ সরকারের এজেন্ডা বা রূপরেখাকে দ্রুত জনগণের সামনে উপস্থাপনের বিষয়ে বেশি তাগাদা দিয়েছেন।

সরকার মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাস করে: প্রধান উপদেষ্টা
ওদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বর্তমান সরকার মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাস করে এবং দেশে একটি গতিশীল ও প্রাণবন্ত গণমাধ্যম দেখতে চায়। সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীরও উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে শফিকুল আলম বলেন, সরকার দেশে একটা গতিশীল গণমাধ্যম দেখতে চায়। এর জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবটুকু করা হবে। একইসঙ্গে তিনি সরকার দেশে মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেন। মতবিনিময় সভায় সম্পাদকগণ সাংবাদিকদের জন্য যেসব কালাকানুন আছে সেগুলো বাতিল বা সংশোধন করার প্রস্তাব করেন।

সরকারের পক্ষ থেকে মিডিয়ার ওপর কোনো ধরনের চাপ নেই উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম মজুমদার বলেন, ‘একটি প্রাণবন্ত ও মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য মিডিয়া কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এই কমিশন আমাদের দেশে মিডিয়া কীভাবে চলবে তা ঠিক করবে।
তিনি বলেন, সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কেউ যেন বিপত্তির মুখে না পড়েন, বাধার সম্মুখীন না হন তা নিশ্চিতে এই কমিশন গঠনের প্রস্তাব এসেছে। সরকার এই কমিশন গঠনের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার সম্পর্কে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সমপ্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং রাজনৈতিক নেতারা অধ্যাপক ইউনূসকে ‘যৌক্তিক সময়সীমার’ মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করতে বলেছেন। সম্পাদকরা সংবিধান সংস্কার এবং আইন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সংস্কার নিয়েও কথা বলেছেন। সম্পাদকরা উপদেষ্টা পরিষদ আরও সক্রিয় করার এবং ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শ দিয়েছেন। প্রেস সচিব বলেন, তারা দেশের সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য একটি সাংবিধানিক সভা করার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন।

প্রেস সচিব জানান, মোট ২২ জন সম্পাদককে মতবিনিময়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে দু’জন বিদেশে থাকায় আসতে পারেননি।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, সংবাদ সম্পাদক আলতামাশ কবির, ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সম্পাদক ইনাম আহমেদ, আমাদের সময় সম্পাদক আবুল মোমেন, ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান, বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, দেশ রূপান্তরের সম্পাদক মোস্তফা মামুন, কালবেলা সম্পাদক সন্তোষ শর্মা, পূর্বকোণ সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিন, করতোয়া সম্পাদক মোজাম্মেল হক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ সভায় অংশ নেন।

সব কালাকানুন বাতিলের দাবি: মতবিনিময় শেষে বেরিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, বিটিভি, বিএসএস এবং রেডিও’র মতো যেসব সংবাদমাধ্যম সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার দাবি তিনি মতবিনিময়ে জানিয়েছেন।

মাহফুজ আনাম বলেন, আমরা কতোগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আশা করছি। সেই সংস্কারের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো, এন্টি করাপশন কমিশন, হিউম্যান রাইটস কমিশন, নির্বাচন কমিশন এগুলোকে সংস্কার করা।
তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে গণমুখী সংস্থা আমরা চাই। নির্বাচন কমিশন যাতে ভবিষ্যতে ভোটারদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটান, এরকম একটা সংস্থা চাই। আমরা এমন দুর্নীতি দমন কমিশন চাই, যেন তারা স্বাধীনভাবে দেশের দুর্নীতি দমন করতে পারে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরোধী সব কালাকানুন বাতিলের দাবি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, সাইবার সিকিউরিটি আইনের মধ্যে সাংবাদিক নিপীড়নের যে অধ্যায়গুলো আছে, সেগুলো কার্যকর হবে না এমনটা যাতে ঘোষণা করা হয়। এটা সংস্কারের জন্য উনারা সময় নিয়ে করতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.