গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পদে থেকে দুর্নীতিতে মাতেন জোবায়ের: পেতেন শেখ রেহানার আশকারা
বেপরোয়া এই ব্যক্তির নাম মেজর জেনারেল (অব.) টি এম জোবায়ের ওরফে বিজু। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার রমজানপুর গ্রামের নিষিদ্ধ চরমপন্থি সংগঠন সর্বহারা পার্টির নেতা মৃত রউফ তালুকদারের ছেলে তিনি। দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে নিজ এবং পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন ও তিনটি দেশে বাড়ি এবং অন্তত চারটি দেশে অর্থ পাচারের তথ্য দিয়ে জোবায়েরের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
যাচাই-বাছাইয়ে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় এরই মধ্যে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
জানা গেছে, নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন সাবেক এই গোয়েন্দাপ্রধান। অবৈধ টাকায় রাজধানীর অভিজাতপাড়ায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রংপুর এবং ভোলায় বিস্তৃত ফসলি জমি, মাদারীপুরে অঢেল সম্পদ গড়েছেন। গাজীপুরের শ্রীপুরে রিসোর্ট, সদরে বহুতল বাড়ি, গ্রামের বাড়িতেও রয়েছে আলিশান বাড়ি। এ ছাড়া অন্তত চারটি দেশে অর্থ পাচার এবং স্ত্রী ও ভায়রার নামে লন্ডন, তুরস্কে একাধিক বাড়ি গড়েছেন। অঢেল সম্পদ গড়েছেন শ্বশুরবাড়ি এলাকায়ও।
জানা যায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত হয়। আওয়ামী লীগ আমলে জাতীয় নিরাপত্তার চেয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজেই এই সংস্থাকে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে শুরু করে দলীয় পদপদবি বণ্টনের ক্ষেত্রেও তথ্য সংগ্রহে এই সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে তাদের রিপোর্টের ওপর বিভিন্ন পর্যায়ে দলীয় মনোনয়ন নির্ভরশীল ছিল। এ কারণে সংস্থার প্রধান হিসেবে প্রচণ্ড প্রভাবশালী ছিলেন জোবায়ের। এ ছাড়াও তার মাথার ওপর ছিল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ছায়া। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, প্রতারণা, অর্থ পাচার, হয়রানি, নির্যাতন এবং সংস্থার নিরীহ কর্মকর্তা- কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা ও বিভিন্ন দণ্ড প্রদানসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তাকে নিয়ে নিজ সংস্থার ভেতরেই ছিল ক্ষোভ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের নামে বিভিন্ন আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া নির্বাচনী তহবিলের নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন। একই কাজ করেন ২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনের সময়ও। দুটি নির্বাচনের আগে জোবায়ের কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থার অফিসের আসবাবপত্র কেনার জন্য প্রতি বছর সরকারের বরাদ্দ কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের বহুতল ভবন নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেন মোটা অঙ্কের কমিশন। ২০২১ সালে একটি আবাসন কোম্পানির এমডির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেন। এ ছাড়াও নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে ওয়াসার এমডি তাকসিমসহ দেশের বিভিন্ন সমালোচিত ব্যক্তির গদি টিকিয়ে রাখতে নিয়মিত সুপারিশ করতেন প্রধানমন্ত্রীর দরবারে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনএম নামে রাজনৈতিক দল তৈরির পেছেনে কলকাঠি নেড়ে সরকারের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া বিএনপিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার মিশন নিয়েও সরকারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের তহবিল নিয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রধান।
জানা গেছে, জুবায়ের দায়িত্বে থাকাকালে সংস্থাটিতে তিনবার জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২০, ২০২২ ও ২০২৩ সালের সেসব নিয়োগে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতান জোবায়ের। কোনো ধরনের নিয়মকানুন না মেনে নিজের চাচাতো ভাই জহিরের সুপারিশে জনপ্রতি ২০ লাখ টাকা করে নিয়ে অন্তত ৫০ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। জোবায়েরের ভায়রা কাইয়ুম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও জানা গেছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সালমান এফ রহমান, পরিবহন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রধান এনায়েত উল্ল্যাহ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদসহ অনেকের সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল টিএম জোবায়েরের।
জানা গেছে, গুলশান ২ নম্বরের ৮৪ নম্বর রোডে গোয়েন্দা সংস্থাটির একটি কার্যালয় শেখ রেহানাকে দেওয়ার কথা বলে দখলে নিয়েছিলেন জোবায়ের। এরপর সেই বাড়ি গণপূর্তের মাধ্যমে তনিজের এক আত্মীয়ের নামে বরাদ্দ দেন। নানা অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। এসব টাকা লন্ডন, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কে পাচার করেছেন। লন্ডনসহ অন্তত ৩টি দেশে তার বাড়িও রয়েছে। দেশে থাকা সম্পদের মধ্যে রয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় রিসোর্ট ও গাজীপুর সদরে বহুতল বাড়ি। রাজধানী ঢাকার উত্তরা ৭নং সেক্টরে নিজের ও বোনের নামে ফ্ল্যাট, উত্তরা রাজলক্ষ্মী মার্কেটে একাধিক দোকান, রংপুরে বিস্তৃত ফসলি জমি দখল, ঢাকার পূর্বাচল ও বসুন্ধরা প্লট, ঢাকার সেগুনবাগিচায় ফ্ল্যাট, ধানমন্ডি
৭/এ-তে ফ্ল্যাট ও সাভার ডিওএইসএসে ১০ তলা বাড়ি। এ ছাড়াও নিজের গ্রামে গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি। নিজের এলাকায় দখলদারিত্ব চালাতেন চাচাচো ভাই জহিরের মাধ্যমে। প্রভাব খাটিয়ে ৬ একর জমি দখল করে জুবায়েরের বাবার নামে বানিয়েছেন আব্দুর রব তালুকদার ভোকেশনাল টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট। আড়িয়াল খাঁ নদের শাখা গৌরনদীর পালরদী নদীসংলগ্ন সরকারি খাস এবং ব্যক্তিমালিকানা জমি দখল করে বানিয়েছেন ‘দক্ষিণ রমজানপুর তালুকদার লঞ্চ টার্মিনাল’। স্থানীয় চুন্নু তালুকদার নামে এক চাচাতো ভাইয়ের ৩ একর জায়গা দখল করে বানিয়েছেন ১০ শয্যাবিশিষ্ট একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। হাসপাতালে রাস্তা করতে স্থানীয় এক গরিব মহিলার ৩ বিঘা ফসলি জমি দখল করা হয়েছে। পাশেই চুন্নু তালুকদারের একটি গাছের বাগান কেটে সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি বানানোর পরিকল্পনা করেছেন। দখলের প্রতিবাদ করায় চুন্নু তালুকদারের ছেলে জিয়াউল তালুকদারকে ধরিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় হত্যা মামলা। এরপর মেহেদী নামে আরও এক ছেলের বিরুদ্ধেও দেওয়া হয় হত্যা মামলা।
যোগাযোগ করা হলে মেহেদী তালুকদার কালবেলাকে বলেন, ‘বিজু (জোবায়ের) তো আমার চাচা। তবে সে খারাপ লোক। আমরা তার পরিচয় দিই না। কেউ জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলি। তার নির্দেশে আমার ভাই জিয়াকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আমাদের দুই ভাইয়ের নামে হত্যা মামলা দিয়েছে। এই কাজটা তারা ঠিক করে নাই।’
জোবায়েরের জমি দখল প্রক্রিয়ায় জড়িত এক ব্যক্তি কালবেলাকে বলেন, ‘এলাকায় জোবায়ের সব জমি কিনেছে চাচাতো ভাই জহিরের মাধ্যমে। জমির দাম কাঠাপ্রতি ২ লাখ টাকার ওপরে। তারা কাউকে ১ লাখ ৩৫ হাজার, কাউকে ৮৫ করে দিয়ে দলিল করে নিয়ে গেছে। জুবায়ের বেশিরভাগ সম্পত্তি তার শ্বশুরবাড়ির এলাকা ভোলায়। এ ছাড়াও তার চাচাতো ভাই জহিরের নামেও অনেক সম্পদ রয়েছে।’
ভোলার একাধিক ব্যক্তি কালবেলোকে জানিয়েছেন, ভোলা শহরের অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জমি রয়েছে সাবেক গোয়েন্দাপ্রধানের। এ ছাড়া সেখানে শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন আত্মীয়ের নামেও জমি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে।
সরকারের একটি অভ্যন্তরীণ নথিতেও বিদেশে জোবায়েরের সম্পদের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, জোবায়ের লন্ডন, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কে বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচার করেছেন। হ্যাম্পশায়ার শহরে গড়ে তুলেছেন কয়েকটি রেস্টুরেন্ট এবং বাড়ি। এ ছাড়া ২৯ লাখ ৪৫ হাজার পাউন্ড বা বাংলাদেশি অর্থে ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে লন্ডনে একটি বিলাশবহুল বাড়ি তৈরি করেছেন। লন্ডনের বেক্সলি এলাকার হেথ কর্ফট ওয়ানশান্ট সড়কের ৭ নম্বর বাড়িটির মালিক সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান। কয়েকটি দেশে পাচারকৃত অর্থে তৈরি করেছেন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করার জন্য নিজের অনুগত কর্মকর্তাদের এসব বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দিয়েছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে মেজর জেনারেল (অব.) টি এম জুবায়েরের সঙ্গে বেশ কয়েকদিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সেটি সম্ভব হয়নি। প্রশ্ন লিখে তার ব্যক্তিগত নম্বরে মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
No comments