কটিয়াদী পাকুন্দিয়ায় সুলতানের সাম্রাজ্য by আশরাফুল ইসলাম
স্থানীয়রা বলছেন, নির্বাচনের পর আরও ভয়ঙ্কররূপে আবির্ভূত হয় সুলতান বাহিনী। এই বাহিনী হয়ে ওঠে কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়ার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক। এমপি বাবাকে সামনে রেখে দুই উপজেলার সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন সুলতান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ম্যানেজিং কমিটি, কালিয়াচাপড়া সুগার মিলের যন্ত্রাংশ ও মালামাল পাচার, বালুমহাল, টিসিবি ডিলারসহ সবকিছুই হতো সুলতানের হাতের ইশারায়। সুলতান নিজেই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ দখল করেন। মাত্র ৭ মাসেই এসব খাত থেকে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সুলতান। এ ছাড়া তার নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জ জেলা জুড়ে গড়ে ওঠে ভারতীয় চোরাই চিনির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। চোরাই এসব চিনি যেতো রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে। চিনি চোরাচালান থেকে সুলতান বিপুল অঙ্কের টাকা কামালেও সংসদ সদস্য বাবার সুবাদে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান তিনি। গত ৮ই মে অনুষ্ঠিত পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে এমপি’র সমর্থনের জন্য তৎকালীন পাটুয়াভাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমদাদুল হক জুটনের কাছ থেকে সুলতান ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। সে সময় বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়। সুলতানকে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে এমপি’র সমর্থন লাভের পরপরই মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ১৬ই এপ্রিল এমদাদুল হক জুটন ইউপি চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন। নির্বাচনের দিন সুলতান বাহিনী তার পক্ষে ভোটে ব্যাপক অনিয়মসহ একাধিক কেন্দ্র দখলে ভূমিকা রাখে। এরপর ফলাফল ঘোষণার সময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে এমদাদুল হক জুটনকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। এ ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বী এক প্রার্থী নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করলে ভোটভর্তি ব্যালটবাক্স আদালতের জিম্মায় রাখা হয়। সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ৪ঠা আগস্ট সোহ্রাব ও তার ছেলে সাগরের নেতৃত্বে পাকুন্দিয়া থানার ওসি আসাদুজ্জামান টিটুসহ থানা পুলিশ ও সুলতান বাহিনী মিলে পাকুন্দিয়া সদরে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। ৫ই আগস্ট পটপরিবর্তনের পর সুলতান বাহিনী উপজেলার দরগা বাজারে সোহ্রাবের বাসভবনকে ঘিরে শক্ত অবস্থান নেয়। সুলতান বাহিনীর পাহারায় গত ১২ই আগস্ট সেখানে একটি সভাও হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতার ক্ষোভের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে গত আগস্ট পিতা-পুত্র পাকুন্দিয়া ত্যাগ করেন।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ২০১৪ সালের পর সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ আত্মসাতসহ ব্যাপক টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি ছিল সুলতান বাহিনীর নিত্যনৈমত্তিক কাজ। এমপির ক্ষমতার প্রভাবে মামলার জালে ঘায়েল করা হতো প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের। এমপিকে প্রধান অতিথি করা ছাড়া এলাকায় কোনো অনুষ্ঠান করা যেতো না। রাজনৈতিক, ক্রীড়া, সামাজিক প্রতিটি অনুষ্ঠানে সোহ্রাবকে প্রধান অতিথি করতে হতো। এর ব্যত্যয় হলে সে অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করে দেয়া হতো। এ ছাড়া সোহ্রাবের সেই মেয়াদে সড়কবাতি প্রকল্পের টেন্ডার বাগিয়ে নিয়ে তার ছেলে সাগর কয়েক কোটি টাকা কামাই করেন। ২০১৯ সালের মে মাসে সাগর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শোভন-রাব্বানী কমিটিতে টাকার বিনিময়ে সহ-সভাপতি পদ বাগিয়ে নেন। সে সময় এ নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়। এর প্রেক্ষিতে সহ-সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সাগর। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৪ই নভেম্বর প্রকাশিত কেন্দ্রীয় যুবলীগের ২০১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নির্বাহী সংসদের সদস্য হিসেবে স্থান পান তিনি। যুবলীগের এই পদকে পুঁজি করে সাগর তার সুলতান বাহিনীর মাধ্যমে এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখেন। ৫ বছর বিরতির পর সোহ্রাবের সর্বশেষ এমপির মেয়াদে মাত্র ৭ মাসেরও কম সময়ে অন্তত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তার ছেলে সাগর। এর মধ্যে কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়া এই দুই উপজেলার বালু খাত থেকেই আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। পিতা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর পরই নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে সাগর জানিয়ে দেন, ‘টাকা খরচ করে আমরা এমপি হয়েছি, এখন আমি সুদে-আসলে সে টাকা তুলবো। এ নিয়ে যেন কারও কোন কথা না শুনি।’ এরপরই শুরু হয় সুলতানের টাকা কামানোর মিশন। এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য সোমবার বিকাল ৫টা ৩৬ মিনিটে এসএম তৌফিকুল হাসান সাগর এর মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
No comments